কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন বিখ্যাত কালীক্ষেত্রগুলিতে বছরভর পুজো দেওয়ার জন্য ভিড় জমান ভক্তরা। তবে বছরের শেষভাগে সেই ভিড় খানিক বেশিই চোখে পড়ে। আবার এই সময়টাতে অনেক ভক্তকে মুলো দিয়ে মায়ের পুজো দিতে দেখা যায়। এমন নিয়মের নেপথ্যে কী কোনও বিশেষ কারণ রয়েছে? আসুন, শুনে নিই।
পৌষ মাসের শনি-মঙ্গলবার মুলো দিয়ে মায়ের পুজো দিলে নাকি বিশেষ পুণ্যলাভ হয়। এমন ধারণা নিয়ে অনেকেই বছরের শেষভাগে মুলো নিয়ে বিভিন্ন মাতৃমন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য ভিড় জমান। বিখ্যাত কিছু কালীমন্দিরের বাইরে থাকা পূজাসামগ্রীর দোকানগুলিতেও বছরের এই বিশেষ সময়ে মুলো এনে রাখা হয়। সেখান থেকে মুলো কিনেই মন্দিরে পুজো দিয়ে থাকেন ভক্তরা।
আরও শুনুন: দেবতাদের সেনাপতি নয়, বাংলার ঘরে কার্তিকের আদর সন্তানের মতোই
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, ‘মা-কে ডাকার জন্য আলাদা করে কোনও দিনক্ষণ লাগে না’! পরমপুরুষের সেই উক্তিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন অন্যান্য ধর্মের সাধকরাও। তবুও শাস্ত্রমতে প্রতি মাসের বিশেষ কিছুদিন মাতৃআরাধনার জন্য উপযুক্ত মনে করা হয়। তেমনই বাংলা মাসের হিসাবে কিছু বিশেষ সামগ্রীও রয়েছে পুজো দেওয়ার জন্য। তেমনই একটি উপকরণ হল মুলো। বলা হয় পৌষ মাসে মুলো দিয়ে মা কালীর পুজো দিলে নাকি বিশেষ ফল মেলে। তবে এর নেপথ্যে শাস্ত্রমতে কোনও ব্যাখ্যা বা যুক্তি নেই বললেই চলে। বরং এই নিয়মের জন্ম কিছুটা হলেও লৌকিক আচারের হাত ধরেই। লৌকিক মতে প্রতি মাসের ষষ্ঠী তিথিকে বিশেষ কিছু ব্রত পালন করা হয়। গ্রাম বাংলার এই লৌকিক উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম এক উৎসব হল ‘মুলো-ষষ্ঠী’। যেখানে নতুন ফলন হওয়া মুলো দিয়ে দেবীর ষষ্ঠীর পুজো করতে হয়। বলা হয়, এই ব্রত নিষ্ঠাভরে পালন করলে নাকি ব্রতীর সন্তান সবর্দা সুস্থ থাকে। তবে মুলো-ষষ্ঠী পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসেই। এর সঙ্গে পৌষমাসে মুলো দিয়ে পুজো দেওয়ার বিশেষ সম্পর্ক নেই। তবে এক অদ্ভুত সমাপতন আছে। বলা যায়, অগ্রহায়ণ মাসের মুলো-ষষ্ঠীর পর যেমন অনেকে বাড়িতে মুলো খাওয়া আরম্ভ করেন। তেমনই পৌষ মাসে মায়ের পুজো দেওয়ার পর এক মাসের জন্য মুলো খান না অনেকেই।
আরও শুনুন: মা কালীর বিশেষ কয়েকটি রূপের পুজো করেন না গৃহস্থরা, নেপথ্যে শাস্ত্রের কোন কারণ?
যদিও কলকাতার বিখ্যাত কালীক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বরের এক পূজারি এ বিষয়ে খুবই যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে শুধুমাত্র প্রচলিত বিশ্বাস নয়, পৌষ মাসের পর মুলো না খাওয়ার নেপথ্যে কিছু বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। মাঘ মাসে মুলোর ভিতর কিছু প্রাকৃতিক পরিবর্তন দেখা যায়। যার দরুন এই সময় ফলন হওয়া মুলো খুবই বিস্বাদ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হয়। তাই পৌষ মাসে মায়ের মন্দিরে মুলো দিয়ে পুজো দেওয়ার পর টানা এক মাস মুলো না খাওয়ার পণ করেন ভক্তরা। একইরকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে মুলো খাওয়া শুরুর সময়য়েও। বিশেষ কিছু গ্রামীণ ব্রত, যেমন ইতুপুজো, নবান্ন, মুলো-ষষ্ঠী- এই সবেতেই প্রসাদ হিসেবে মুলো খেতে হয়। আর বছরের এই সময়টায় নতুন ফলন হওয়া মুলো শীতকালের কিছু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। সেক্ষেত্রে যাঁদের এই শীতকালীন সবজিটি বিশেষ পছন্দের নয় তাঁরাও প্রসাদের অছিলায় এক কুচি মুখে দেন। সব মিলিয়ে লৌকিক আচারের বেড়াজালের মধ্যে এভাবেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞরা। যা যুগ যুগ ধরে দৈবের আড়ালে সেই নিয়মই হয়ে পালিত হয়ে আসছে।