হারিয়ে ফেলা ওয়ালেট ফিরিয়ে দিলেন যে ট্যাক্সিচালক, তিনিও সুপারহিরো। ওই যে রোদের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে ট্র্যাফিক সামলাচ্ছেন, তাঁকেও সুপারহিরো বলাই যায়। এভাবেই বৃত্ত ছোট ছোট হতে, আয়নার সামনে দাঁড়ানো নিজেকে দেখেও মনে হতেই পারে, সুপারহিরো!
ছোটদের কাছে সুপারহিরোর সংজ্ঞা অনেকটা এক। তিনি বিপদের ত্রাতা, তিনিই ভরসা। বিপদ হলেই, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসবেন! আর তাতেই যাবতীয় বিপদ কেটে যাবে। কখনও সঙ্গে নিয়ে উড়েও যেতে পারেন। এক্ষেত্রে একটা জিনিস আবশ্যক, বাহারি পোশাক।
একটু বড় হলে সংজ্ঞাটা বদলায়। সবার নয় অবশ্যই, কারও কারও ক্ষেত্রে। পরিস্থিতি বাধ্য করে সুপারহিরোর ধারণা বদলাতে। কখনও রাস্তা পেরোনোর সময় আচমকা হাত ধরে পিছনে টেনে নেওয়া ভদ্রলোক, সুপারহিরো। ভাগ্যিস ঠিক সময় টান দিয়েছিলেন, নাহলে জীবনটাই যেত! কিংবা হারিয়ে ফেলা ওয়ালেট ফিরিয়ে দিলেন যে ট্যাক্সিচালক, তিনিও সুপারহিরো। ওই যে রোদের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে ট্র্যাফিক সামলাচ্ছেন, তাঁকেও সুপারহিরো বলাই যায়। এভাবেই বৃত্ত ছোট ছোট হতে, আয়নার সামনে দাঁড়ানো নিজেকে দেখেও মনে হতেই পারে, সুপারহিরো!
ধরে নেওয়া যাক জীবন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানে টিকে থাকাটাই দস্তুর। যাবতীয় দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। কে শত্রু, কে মিত্র বুঝতে হয়। নাহলেই বিপদ! আর সেই বিপদের হাত থেকে যিনি বাঁচাবেন, তিনিই সুপারহিরো। জীবনের গল্পে সেটাও আলাদা কেউ নন। বরং নিজেকে গড়ে তোলাই সুপারহিরোর ক্ষমতা বাড়ানোর একমাত্র পথ। ঠিক যেভাবে নিজেকে গড়ে বাস্তবের সুপারহিরো হয়েছেন কেউ কেউ। এঁরা প্রত্যেকেই জীবনের সেই যুদ্ধটা জিতেছেন, যেখানে নিজের বেঁচে থাকার চেয়েও অন্যকে বাঁচিয়ে রাখাটা জরুরি ছিল। এঁরা সেই যুদ্ধে জিতেছেন যেখানে নায়কের জন্য আলাদা কোনও মঞ্চ নেই, বেঁচে ফেরাটাই একমাত্র পুরস্কার। আলোচনা হয় কয়েকটা দিন, এইটুকুই সম্বল তাঁদের।
কাশ্মীরের কথাই ধরা যাক। সন্ত্রাসের কালো ছায়া যখন ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে ভূস্বর্গের মায়াভরা আলোর পরিবেশ, তখন একদিকে টাট্টু ঘোড়াচালক কাশ্মীরী যুবক আদিল বন্দুক কেড়ে নিয়ে নিরস্ত করতে গেলেন সন্ত্রাসবাদীদের। অন্যদিকে সামান্য বিপদের আভাস পেতেই ট্যুর গাইড নজাকত সত্বর নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেলেন পর্যটকদের। কাশ্মীরী মেয়ে-বোনেরা বাড়ির দরজা খুলে দিলেন পর্যটকদের জন্য। গাড়িচালকেরা বিনামূল্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব রাখলেন। কোনওক্রমে বাঁচাতে হবে, এই পণ নিলেন সবাই। এঁদের গায়ে বাহারি পোশাক নেই বলে কি এঁরা সুপারহিরো নন?
শুধু কাশ্মীর কেন, নাসিকের চন্দ্রকিশোর পাতিল, যিনি হাজারও হুমকি, অপমান, লাঞ্ছনা সয়েও বিগত দশ বছর ধরে রক্ষা করে চলেছেন স্থানীয় নন্দিনী নদীটিকে। চন্দ্রকিশোরের দাবি, কিছুতেই এই প্রাণদায়ী জলাধারটিকে ময়লা ফেলার ভাগাড় হয়ে যেতে দেবেন না তিনি! কিংবা দক্ষিণ ভারতের ডি শিভাকুমার। নিজে মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে ইঁটভাটায় কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই বর্তমানে যখন নিজের চেষ্টায় সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন, তখন প্রাথমিক লক্ষ্যই স্থির করেছেন স্রেফ শিশু শ্রমিকদের হকের লড়াইয়ে শামিল হওয়া। তাঁর হাত ধরে আজ নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছে অনেকজন হতভাগ্য শিশু। এঁরা সুপারহিরো নন?
আচ্ছা, শুধু বড়রাই কেন? যোগীরাজ্যের কোলারা কালান গ্রামের একমাত্র মদের দোকান স্থানীয়দের কাছে বিভীষিকা হয়ে উঠেছিল অল্পদিনেই। অনেকেই দিনের শেষে ভিড় জমাচ্ছিলেন সেখানে, পথ খুলে যাচ্ছিল নানা অসামাজিক কাজকর্মের। শ্লীলতাহানির ভয়ে এলাকার মহিলারা সন্ধের পর সেখান দিয়ে যেতে ভয় পেতেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে বার-দুয়েক। এমতাবস্থায় গ্রামের মাত্র দশ বছর বয়সি এক খুদে মদের দোকানটি বন্ধের দাবিতে অনশনে বসল। প্রথম প্রথম হালকাভাবে নিলেও, পরে যখন ১৭দিন ধরে সে একটানা অনশনে অনড় থাকে, দোকানটি বন্ধ করতে বাধ্য হলেন মালিক! এই খুদেটি সুপারহিরো নয়?
প্রশ্নগুলো থাকবেই। কারণ সিনেমায় সবসময় এমন কিছু দেখানো হয় না। হলেও যে খুব একটা ফারাক পড়ত তা নয়। শিশুমন যা কিছু রঙিন তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইবে। সেই হিসাবে বাহারি পোশাক, অমানুষিক শক্তি, অতিমানবিক ক্ষমতা, বেশ আকর্ষক মনে হতে বাধ্য। টিভিতে দেখানো সেই হিরোরাও যে ‘সুপার’, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরাই একমাত্র ‘সুপারহিরো’ এই ভাবনাটা বদলে নেওয়া দরকার। সে ধারণা যত ছোট বয়সে হয়, তত ভালো। তবেই না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একদিন নিজের মধ্যেই ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান কিংবা সুপারম্যানকে দেখতে পাবে সে!