চলতি বছরের মার্চে এক কন্যা সন্তানের অভিভাবক হয়েছেন তাঁরা দুজনে। মেয়ের নাম রেখেছেন ‘ভারতী’, তা যেন খানিক এ দেশের প্রতি সীমার আনুগত্যেরই পরিচয় দেয়। হয়তো জন্ম সূত্রে শত্রু দেশের নাগরিক ছিলেন বলেই ক্রমাগত আচারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন সীমা, ভারতের প্রতি তাঁর ভালবাসা নিখাদ। কিছুমাত্র খুঁত নেই তাতে। কিন্তু বাস্তবের পৃথিবীর রুক্ষতা বোধহয় কেবল ভালোবাসা দিয়ে অতিক্রম করা যায় না।
‘বীর-জারা’ সিনেমায় ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রেমে পড়েছিলেন শাহরুখ খান ও প্রীতি জিন্টা অভিনীত চরিত্র দুটি। পরবর্তীকালে যখন জারা (প্রীতি)-কে পাকিস্তানে ফিরে যেতে হয়, তখন সমস্ত সীমান্ত পেরিয়ে ভালোবাসার টানে তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হয় নায়ক। দেখিয়ে দেয় যে, ভালোবাসা সব পারে। যে দুটি দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিটুকুই অস্বস্তি ও সমঝোতার, ভালোবাসার কাছে সবই যেন গৌণ হয়ে পড়ে। ভালবাসার এই জয় উদযাপন করে সিনেমা-সাহিত্য। বারবার জানান দেয় যে ভালবাসার চাইতে শক্তিধর বুঝি আর কিছু নেই জগতে।
কিন্তু বাস্তব কি সিনেমার মতো! একেবারেই নয়। বাস্তব বলছে অন্য কথা। এখানে ধর্মান্ধতায় নির্বিচারে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করা যায়। এমনকি বড়দের পৃথিবীকে চাক্ষুষ করে এসে, ক্লাসরুমের অবুঝ ক্ষুদেরা অবধি ধর্ম তুলে আঘাত হানতে যায় একে অপরকে। প্রেমের কবিতা-গল্প-ছবির মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে বাস্তব বারবার প্রমাণ করে দেয় যে, আদতে গাছতলায় বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার মতো, ফুল-পাতা-মেঘের শোভা দেখবার মতো বাহুল্য করা চলে না। এ যেন পৃথিবী কেবল হিংসার। সেখানে ভালবাসা, দুর্বলতারই নামান্তর।
আর তাই ‘ভালবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো’ বলা বুঝি কবিতাতেই মানায় কেবল। নাহলে বাস্তবে যে মেয়েটি কেবল ভালোবাসার টানে স্বামী-সন্তানের সাজানো সংসার পিছনে ফেলে, দেশের সীমান্ত পার করেছিলেন, তাঁর প্রেমের শেষরক্ষা হল না কেন? ২০১৯ সালে অনলাইন গেম খেলতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশবাসী শচীন মিনা-র সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সীমা হায়দারের। সীমা সে সময়ে পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চলে তাঁর স্বামী গুলাম হায়দার ও চার সন্তানের সঙ্গে বাস করেন। শচীনের সঙ্গে আলাপ ধীরে ধীরে গড়ায় প্রেমে। ২০২৩ সালে সকলের অজান্তে, গোপনে দেশের সীমান্ত পার করেন সীমা। এবং নেপালের পথে প্রবেশ করেন ভারতে। তারপর নয়ডায় এসে নতুন করে ঘর পাতেন শচীনের সঙ্গে। তাঁদের বর্তমান ঠিকানা উত্তরপ্রদেশ।
চলতি বছরের মার্চে এক কন্যা সন্তানের অভিভাবক হয়েছেন তাঁরা দুজনে। মেয়ের নাম রেখেছেন ‘ভারতী’, তা যেন খানিক এ দেশের প্রতি সীমার আনুগত্যেরই পরিচয় দেয়। হয়তো জন্ম সূত্রে শত্রু দেশের নাগরিক ছিলেন বলেই ক্রমাগত আচারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন সীমা, ভারতের প্রতি তাঁর ভালবাসা নিখাদ। কিছুমাত্র খুঁত নেই তাতে। কিন্তু বাস্তবের পৃথিবীর রুক্ষতা বোধহয় কেবল ভালোবাসা দিয়ে অতিক্রম করা যায় না।
গত ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলায় কাশ্মীরের পেহেলগাঁও-এ অকালে প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন পর্যটক। গুলি চালানোর আগে ধর্মীয় পরিচয় জানতে চাওয়া বা নিহত ব্যক্তির পরিবারকে মোদিকে খবর দিতে বলা – সন্ত্রাসীদের এ সমস্ত কার্যকলাপ দুই দেশের মধ্যবর্তী সম্পর্কের বিদ্বেষ আরও উস্কে দিয়েছে। এ অবস্থায় একেবারে স্বল্প সময়ের নোটিসে, পাকিস্তানের সঙ্গে সিংহভাগ ব্যবসায়িক তথা সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নিদান দিয়েছেন, আগামী ২৭ এপ্রিলের মধ্যেই ভারতে সাময়িকভাবে বসবাসকারী সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিকের ভিসা বাতিল হয়ে যাবে। অতএব এমতাবস্থায় সত্ত্বর ভারত ছেড়ে পাকিস্তান ফিরে যাওয়া ব্যতীত আর কোনও উপায় নেই। এই পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে সীমার ভালবাসা যেন তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়তে চলেছে।
কিন্তু একরত্তি কন্যা সন্তানকে নিয়ে কোথায় ফিরবেন সীমা? তাই নিতান্ত অসহায় হয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সীমার আবেদন, তাঁকে যেন ভারতের নাগরিক হিসেবে মঞ্জুর করা হয়। তাঁর আরজি, তিনি পাকিস্তানের মেয়ে হলেও ভারতের বধূ। বিবাহ ও সন্তানের জন্মের পর সীমার পরিচায়ক তাঁর হিন্দু স্বামীই। সুতরাং কাগজে-কলমে না হলেও হৃদয়ে তিনি ভারতীয়!
কিন্তু তাঁর কাতর আর্জি কি আদৌ এই পরিস্থিতিতে কার্যকরী হবে? প্রশ্ন তো থেকেই যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখা যায় কেবল হিংসে-বিদ্বেষের নিরন্তর বহিঃপ্রকাশ। শিল্পীদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ভারতের প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি অভিনেতার সিনেমা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন এ দেশের নাগরিকেরা। আসলে সন্ত্রাস হামলার মতো ঘটনা যেন ফিরিয়ে এনেছে যুদ্ধং দেহি মনোভাব। তা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, সে প্রসঙ্গ অন্য আলোচনার বিষয়। তবে যে প্রশ্ন বিদ্ধ করছে, তা হল, এই বৈরিতার আবহে ভালোবাসা কি আদৌ কি গণ্য করার মতো বিষয় হবে! সীমা কি আদৌ থাকতে পারবেন এই দেশে! আপাতত প্রশাসনই সে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এহেন পরিস্থিতি আসলে মূল একটি বিষয়ই মনে করিয়ে দেয়। বাস্তব কখনোই সিনেমার মতো নয়। অথচ ভালোবাসা বাস্তব, বাস্তবিকই তা সিনেমার মতোই। ভালোবাসা দিয়েই হয়তো বৈরিতা মুছে ফেলা যায়। তবে, বৈরিতা কি ভালোবাসাকে টিকে থাকার অনুমোদন দেবে!
সীমা তাই এখনও জানেন না, তাঁর ভালোবাসা পোয়েটিক জাস্টিস পাবে কিনা! যদি পায়, তবে হয়তো এই হিংসার পৃথিবীতে সত্যি হয়েই জেগে থাকবে কবিতা, বেঁচে থাকবে ভালোবাসার একচিলতে সুখস্বপ্ন।