এপ্রিল মাসটিকে তকমা দেওয়া হয়েছে ‘দলিত হিস্ট্রি মান্থ’-এর। মূলস্রোতের সমাজ দলিত ব্যক্তিত্বদের কৃতিত্বের উপর যে কালো পর্দা চাপিয়ে রেখেছে, তার বিরোধিতা করাই এর উদ্দেশ্য। আর সে জন্যই ভারতীয় সিনেমাতেও দলিত মানুষদের ক্ষেত্রে যে সচেতন ‘এক্সক্লুশন’-এর প্রবণতা চোখে পড়ে, তার আলোচনা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
সদ্য জনপ্রিয় হওয়া ‘জাট’ সিনেমায় খলনায়ককে ধমক দিচ্ছেন সানি দেওল, আদেশ করছেন ক্ষমা চাওয়ার জন্য। বদলে খলনায়ক তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে সানি বলছেন, তিনি একজন ‘জাট’। অর্থাৎ নাম নয়, ঠিকানা নয়, এমনকি অন্য কারুর সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতেও নয়, সম্প্রদায়-জাতের পরিচয়েই তাঁর প্রাথমিক পরিচিতি। আর এরপরই সানি উত্তমমধ্যম ধোলাই দিচ্ছেন খলনায়কের দলকে। জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলছেন, উলটে দিচ্ছেন। সিনেমায় দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ তাঁর নাম দিয়েছেন ‘বুলডোজার’। অর্থাৎ অন্যায়ের প্রতিকার আর বুলডোজার যেন কোথাও গিয়ে সমার্থক হয়ে পড়ছে। একটিমাত্র সিনেমা নয়। সাম্প্রতিক একাধিক সিনেমার দিকে তাকালেই দেখা যাবে ‘আলফা মেল’-এর জয়জয়কার। ‘টক্সিক ম্যাস্কিউলিনিটি’-র এই বাড়বাড়ন্তের আড়ালে চোখে পড়ে আরও একটি বিষয়। ‘অ্যানিম্যাল’, ‘জাওয়ান’, ‘সাহু’, ‘কবীর সিং’, ‘দাবাং’, কিংবা ‘টাইগার’ ফ্র্যাঞ্চাইজির সিনেমাগুলো খতিয়ে দেখলেই লক্ষ্য করা যায় যে, মুখ্য ভূমিকায় থাকা যে চরিত্রটি কারণে অকারণে পেশিশক্তির চূড়ান্ত আস্ফালন করে থাকেন, তাঁর পদবিই জানিয়ে দেয় যে, তিনি উচ্চবংশের সন্তান। এমনকি সিরিয়ালগুলোর ক্ষেত্রেও অব্যাহত থাকে এই ট্রেন্ড। রাঠোড়, সিং, পাণ্ডে, ঠাকুর, সিঙ্ঘানিয়া, রায়চন্দ – নায়ক হতে গেলে তাঁর জন্ম হতে হবে কোনও তথাকথিত ‘সম্মানজনক’ বংশে। ভাবুন তো, নায়ক একে-তাকে মেরে নিজের হক আদায় করে নিয়ে যাওয়ার বেলায় নিজের পরিচয় দিচ্ছেন ‘দলিত’ বলে, এমনটা ঠিক কল্পনা করা যাচ্ছে কি? যাচ্ছে না। কেন? কারণ হয়তো আমরা সকলেই দীর্ঘকাল ধরে বলিউডের চাপিয়ে দেওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যকে স্বীকৃতি দিয়েছি মনে মনে।
এপ্রিল মাসটিকে তকমা দেওয়া হয়েছে ‘দলিত হিস্ট্রি মান্থ’-এর। এ মাসের ১৪ তারিখেই ভীমরাও রামজি আম্বেদকর-এর জন্ম হয়েছিল। যাঁকে দীর্ঘদিন অবধি বলিউড জায়গা দিয়েছিল কেবলমাত্র থানা কিংবা সরকারি অফিসের দেওয়ালে ঝুলন্ত ফটোফ্রেমে। যেন অন্ধকার কূপ থেকে ভারতবর্ষকে আলোয় তুলে আনবার পিছনে তাঁর অবদান এমন কিছু উল্লেখের দাবি রাখে না। পুরাকাল থেকে আজ অবধি মূলস্রোতের সমাজ যে দলিত ব্যক্তিত্বদের কৃতিত্বের উপর জোর করেই কালো পর্দা চাপিয়ে রেখেছে, তার বিরোধিতা করে ‘দলিত হিস্ট্রি মান্থ’। তাঁদের কাহিনিগুলোকে নতুন করে ‘লাইমলাইট’-এ আনার অঙ্গীকার জানায়। আর সে জন্যই ভারতীয় সিনেমাতেও দলিত মানুষদের ক্ষেত্রে যে সচেতন ‘এক্সক্লুশন’-এর প্রবণতা চোখে পড়ে, তার আলোচনা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
১৯৭০-৮০ নাগাদ মহারাষ্ট্রের ‘দলিত প্যান্থার’ ও উত্তর ভারতের ‘বহুজন সমাজ পার্টি’-র উত্থানের আগে পর্যন্ত ভারতীয় সিনেমায় আম্বেদকরের উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও জাতীয় আইকন হিসেবে গান্ধী, নেহরু, ভগৎ সিং, সুভাষ চন্দ্র বসু-র উত্তরণ ঘটছে প্রায় ঈশ্বরসম আসনে। শুধু যে দলিত বা সমাজের অন্য কোনও নিম্নবর্গীয় চরিত্রের অন্তর্ভুক্তি নেই তাই-ই নয়, নয়ের দশকের বেশিরভাগ সিনেমা-সিরিয়াল যেন সচেতনভাবেই তুলে ধরত সমাজের এক পরিমার্জিত চিত্র। যেখানে কেবল উচ্চবিত্ত মানুষদের সুখ-দুঃখের কথা বলা হত। গরিব কোনও চরিত্রকে দেখানো হলেও, বাদ দেওয়া হত তেমন কোনও শব্দ যা তার জাতির পরিচয় বহন করতে পারে। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব্যান্ডিট কুইন’ সিনেমাটি তাই দলিত নারী ফুলনের যন্ত্রণার উপাখ্যান লিখে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এরপর একে একে প্রকাশ পায় মারাঠি সিনেমা ‘মুক্তা’ (১৯৯৫), তামিল সিনেমা ‘ইরানিয়ান’ (১৯৯৯)।
ধীরে ধীরে পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল ভারতীয় সিনেমায়। ২০০৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যেই নানা ভাষায় একাধিকবার তৈরি হল আম্বেদকরের জীবনীমূলক বেশ কিছু সিনেমা। তবে এ কথা বললে ভুল হয় না যে, চলচ্চিত্র জগতে দলিত চরিত্রদের ঠাঁই পাকা হল, আমূল পরিবর্তন এল ঠিক তখন, যখন পরিচালকের আসনে বসলেন দলিত-বহুজন সমাজভুক্ত মানুষরা। নাগরাজ মঞ্জুলে বানালেন ‘ফ্যান্ড্রি’, ‘সইরাট’, ‘ঝুন্ড’-এর মতো সিনেমা। পিএ রঞ্জিত নির্মিত ‘কাবালি’ ও ‘কালা’-র মতো সিনেমা সরাসরি প্রশ্ন তুলল ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের চোখে চোখ রেখে। ‘ঝুন্ড’-এ দেখা গেল, দলিত মানুষেরা শামিল হয়েছেন আম্বেদকরের জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানে। আড়ম্বরে গান্ধীজয়ন্তী কিংবা নেতাজী জয়ন্তী-র থেকে এর কিছুমাত্র তফাত নেই। ‘জয় ভীম’ ও ‘মামন্নান’-এ থেকে আরও একধাপ এগিয়ে তুলে ধরা হল দলিত শ্রেণির মানুষদের প্রতি প্রশাসনের অত্যাচার ও অবমামনার কথা। ‘অমর সিং চমকিলা’ দেখাল যে, গায়ক দলিত শ্রেণিভুক্ত হলে তাঁর সাফল্যের পথ অন্যদের চাইতে আরও দুর্গম হয়ে ওঠে বইকি! এই সিনেমাগুলোতেই মূলত নিজস্ব দুঃখ-কষ্ট-প্রেম-বেদনা নিয়ে নামভূমিকায় হাজির হলেন দলিত চরিত্রেরা। বিশ্বমানের সিনেমা ‘অরিজিন’-এ সমাজ সংস্কারক হিসেবে আম্বেদকরের উল্লেখ জানিয়ে দেয় যে, মূলধারার সিনেমায় একটা সুস্পষ্ট ‘জঁর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলিত মানুষদের দৈনন্দিন সংগ্রামের গল্প।
সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের এক স্কুলে, ঋতুমতী কিশোরীকে পরীক্ষার হল-এর বাইরে বসে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছেন শিক্ষক, ছাত্রীটির দোষ এটুকুই যে, সে দলিত। এ ছাড়াও বারবার উঠে আসে তথাকথিত উচ্চবংশীয় মানুষদের হাতে দলিতদের হেনস্তা হওয়ার ঘটনা। কখনও হয়তো দলিত কিশোরকে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে অপমান করা হয়, কখনও মদ্যপ অবস্থায় প্রস্রাব করে দেওয়া হয় দলিত যুবকের গায়ে। সাম্প্রতিককালে জ্যোতিবা ও সাবিত্রীবাই ফুলে-র জীবনের উপর আধারিত ‘ফুলে’ সিনেমাটির উপর যেভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী কোপ নেমে এসেছে, তা দেখেই বোঝা যায় যে দলিত মানুষদের কথা আরও বেশি করে বলবার প্রয়োজন কেন রয়েছে। ‘ভেদা’, ‘বাইসন’, ‘বিরসা মুন্ডা’ প্রভৃতি সিনেমাগুলো যে বিপ্লবের সূচনা করেছে, আশা করা যায় যে, তা আরও বহুদূর এগোবে।
ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতেও এই পরিবর্তন বেশ উল্লেখযোগ্য। আধিপত্যবাদী রাজনীতির দাপট যত পাড়ে তত লিঙ্গপ্রান্তিক বা জাতিপ্রান্তিক মানুষের অবস্থা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তাত্ত্বিক ভাবে তার প্রতিরোধ যেমন জরুরি, তেমনই সিনেমার মতো জনপ্রিয় মাধ্যমেও এই কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি জরুরি। একদিকে তাই যেমন বুলডোজার-কে স্বীকৃতি দিচ্ছে এক গোত্রের সিনেমা, অন্যদিকে তেমন উঠে আসছে প্রান্তিক মানুষের অধিকা রক্ষার ইতিবৃত্ত। আর সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই অমোঘ হয়ে উঠছেন আম্বেদকর। বলা যায়, বুলডোজার বনাম আম্বেদকর- এই দ্বন্দ্বের ভিতরই দেশের প্রকৃত স্বরূপের খোঁজ করছে ভারতীয় সিনেমা।