কথায় বলে, রাধাকৃষ্ণের দোল! কারণ, দোলের সঙ্গে মূলত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের যোগ চোখে পড়ে। তবে দেশের সর্বত্র ছবিটা এরকম নয়। বেনারসেই দোল পালিত হয় মহাদেবকে কেন্দ্র করে। উদযাপনের ধরণও একেবারে আলাদা। ঠিক কেমন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
আবিরের চিহ্নমাত্র নেই। রঙেরও না। আকাশ বাতাস ঢেকেছে ধূসর ছাইয়ে। অথচ সবাই বলছেন, ‘বুরা না মানো হোলি হ্যায়!’ প্রশ্ন উঠবেই, এ কেমন হোলি? আসলে, এ হল সেই ‘হোলি’ যা কোনও সিনেমায় দেখানো হয় না, কিংবা যা নিয়ে আলাদা কোনও গান লেখা হয় না। অথচ এতে অংশ নেওয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে অনেকে হাজির হন, বেনারসে।
:আরও শুনুন:
শুধু ভারত নয়, বসন্তের রং লাগে গোটা বিশ্বেই! কোন দেশে কীভাবে হয় উদযাপন?
কথা বলছি, ‘মশান হোলি’ সম্পর্কে। নামেই শ্মশানের উল্লেখ, সুতরাং এক্ষেত্রে উদযাপনও যে অন্যরকম হবে, তা বলাই বাহুল্য। তাই রঙ নয়, এখানে হোলি খেলা হয় ছাই দিয়ে। তাও আবার চিতাভষ্ম। গোটা দেশ যেদিন দোল পালন করে, মশান হোলি হয় তার দিন পাঁচেক আগে। তাই আগেভাগে হাজির হন পর্যটকরা। কাশীধামে শিবের বাস, একথা অনেকেই বিশ্বাস করেন। তবে সামনে থেকে শিবকে প্রত্যক্ষ করতে হলে, মশান হোলির সময় বেনারসে পা রাখতে হবে। একা শিব নন, বেনারসের অলিতে গলিতে এইসময় ঘুরে বেড়ান শিবের হাজার হাজার অনুচরেরা। আসলে, ভক্তরাই এমন সেজে রাস্তায় নামেন। মেতে ওঠেন বিশেষ হোলি খেলায়। যেখানে রঙ নয়, প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভষ্ম। এমনিতে শিব আরাধনার সঙ্গে ভষ্মের বিশেষ যোগ রয়েছে। পুরাণ বলে, মহাদেব শ্মশানচারী। সারাদিন গায়ে-মাথায় ছাই মেখে বসে থাকেন। অনুচরেরাও তাঁকে সঙ্গ দেন। সেই প্রসঙ্গ ধরেই বারানসীতে মশান হোলির প্রচলন। কেউ কেউ আবার বলেন, এর সঙ্গে শিব-পার্বতীর বিবাহের যোগ রয়েছে। কথিত আছে, গিরিরাজের বাড়িতে পার্বতীকে বিয়ে করতে আসার সময় মহাদেব স্বমূর্তিতেই এসেছিলেন। অর্থাৎ বরের বেশে ধোপদুরস্ত হয়ে নয়, একেবারে ছাই মাখা ভুত হয়ে। আর বরযাত্রী হিসেবে মহাদেবের সঙ্গে ছিলেন তাঁর অনুচরেরা। এমন বহর দেখে স্বয়ং মেনকা নাকি অজ্ঞান হয়ে যান। আর সেই ঘটনাকেই যেন স্মরণ করা হয় মশান হোলির সময়। আলাদা করে শিব এবং পার্বতী সাজানো হয় দুজনকে। চিতাভষ্মর সামনে তাঁদের প্রতীকী বিয়েও দেওয়া হয়। সেইসময় তাঁদের ঘিরে নাচ শুরু করেন বাকীরা। আর আকাশ বাতাসে ঢেকে যায় সেই ছাইয়ে। যেন রঙ নিয়ে হোলি খেলা হচ্ছে, এভাবেই ছাই মাখাতে থাকেন একে অন্যকে। সাধুরাই মূলত অংশ নেন এই খেলায়। তবে বাংলায় দোল বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ বসন্ত উৎসব জাতীয় কোনও স্নিগ্ধতা এখানে নেই। বরং উগ্রতার প্রদর্শনই ধরা পড়ে।
:আরও শুনুন:
দোলের দিনেও রঙের ছোঁয়া লাগে না দেশের যেসব গ্রামে
বর্তমানে রিলসের সৌজন্যে এই মশান হোলি নেটদুনিয়াতেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। অনেকেই সামনে থেকে তা দেখতে বেনারস হাজির হচ্ছেন। তবে একসময় এই উৎসব স্রেফ সাধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশেষ করে নাগা সাধুরা। আসলে, ধর্মীর রীতি পালনের চাইতেও এই ধরনের উৎসবে যা মুখ্য হয়ে ওঠে তা হল নিজেদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখা। নাগা সাধুদের জীবনে ভষ্ম অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই এইভাবে ভষ্ম মাখার উৎসব যাপনে তাঁরা নিজেদের সংস্কৃতিকেই সম্মান জানান। তবে বর্তমানে সকলেই এতে অংশ নেন। সরাসরি না হলেও, মোবাইল বন্দি করার সুযোগ থাকে সকলের জন্য। তাও প্রত্যক্ষভাবে মশান হোলিতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা হাজার পঞ্চাশ ছাপিয়ে যায় অনায়াসে। কাউকে আঘাত করার উদ্দেশে উগ্রতার প্রদর্শন নয়, এঁরা নিজেদের সহজাত ভঙ্গীর প্রকাশেই ওমন বীভৎস রূপে ধরা দেন। গলায় নরমুণ্ড, হাতে ত্রিশূল, মাথায় জটা, কেউ কেউ সত্যিকারের সাপও ঝুলিয়ে রাখেন গলায়! সেই অবস্থায় ছাই ওড়া বাতাসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে শোভাযাত্রা। কাশীর শ্মশান ঘাটগুলিও বিশেষ প্রসিদ্ধ। প্রত্যেকটিই সঙ্গে পুরাণের যোগ রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্য মেশানো সেইসব শ্মশানেই মহাসমারোহে পালিত হয় মশান হোলি। বেনারসের বাসিন্দারা এই দিনটাকে অতি পবিত্র মনে করেন। আলাদা করে দোল উদযাপন হলেও, এই দিনটাই তাঁদের কাছে প্রধান। কেউ কেউ ভষ্ম সংগ্রহ করে সারাবছর বাড়িতে রেখে দেন। বিশ্বাস, এই বিভূতি সংসারে মঙ্গল বয়ে আনবে। বিশ্বেশ্বর মন্দিরও এই উপলক্ষে বিশেষ সাজে সেজে ওঠে। সেখানেও আলাদা করে পুজোর ব্যবস্থা হয়। সবমিলিয়ে মশান হোলির সময় কাশীধামে পা রাখলে বোঝার উপায় নেই, এই উৎসব আসলে বৈষ্ণবদের। আসলে, যেখানে শিবের নামেই সবকিছু, সেখানকার উৎসবেও যা তিনিই প্রাধান্য পাবেন, তা বলাই বাহুল্য।