‘বোম্বে’ মুক্তির পর তিন দশক পেরিয়েছে। এর মধ্যে বদলেছে অনেক কিছু। বিশেষ করে বিনোদন জগতে। সেই বদলে যাওয়াকে ইঙ্গিত করেই সম্প্রতি বিশেষ মন্তব্য করেছেন, বোম্বে-র সিনেমাটোগ্রাফার রাজিব মেনন। তাঁর প্রশ্ন, আজকের ভারত বোম্বের মতো সিনেমা মেনে নিতে পারত? আর কী বলেছেন তিনি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
মুসলিম মেয়ে। হিন্দু ছেলে। প্রেম করেছে। বাড়ির অমতে বিয়েও করেছে। ঝামেলা-অশান্তি থেকে বহুদূর সরে গিয়ে সংসার করেছে। নিজেদের মতো করে জীবনটা বাঁচার চেষ্টা করেছে। এসব যখন হচ্ছে, তখন সমাজ সম্প্রীতি বলতে কিছু বোঝে না। হিংসার আবহ চারপাশে। সাম্প্রদায়িক অশান্তি এতটাই চরমে, বহু রক্তপাতের সাক্ষী থাকছে দেশের প্রতিটা অলি-গলি।
বাস্তব নয়, সিনেমার কথা। তবে দৃশ্যগুলো বড্ড চেনা। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন অনেকেই রয়েছেন সিনেমাটা বেশ কয়েকবার দেখেছেন। কেঁদেছেন, হেসেছেন, মুগ্ধ হয়েছেন। সমাজের ছবিটা এত স্পষ্টভাবে বোধহয় খুব কম সিনেমায় দেখানো হত সেকালে। তবে শুধু সমাজের ছবি নয়, প্রেমের বয়ানেও যে কোনও ব্লকবাস্টার সিনেমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারে ‘বোম্বে’। মনিরত্নম পরিচালিত এই সিনেমা এখনও চর্চার কেন্দ্রে থাকতেই পারে, অনায়াসে। তার কারণ এক নয়, একাধিক। ওই যে বললাম- প্রেম, সমাজ, সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আরও কত কিছু সিনেমার ভাষায় ফুটে উঠেছিল। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেসব ঘটনা বড়সড় দাগ কেটেছিল, বাবরি মসজিদের উধাও হওয়া তার মধ্যে অন্যতম। সেই সময়কার পরিস্থিতি, দুই সম্প্রদায়ের অশান্তি, এতটাই স্পষ্টভাবে বোম্বে সিনেমায় দেখানো হয়েছিল, যা ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব। তার আড়ালে নিখাদ একটা প্রেমের গল্প। ভালোবাসা যে আদৌ কোনও বাঁধন মানে না, তা এই সিনেমায় প্রমাণ করেছিলেন পরিচালক। কিন্তু আজকের ভারত কি এই ধরনের সিনেমা মেনে নিতে পারবে?
প্রশ্ন তুলেছেন, বোম্বে-র সিনেম্যাটোগ্রাফার রাজীব মেনন। শুধু এই একটি সিনেমা নয়, বলিউড সহ দক্ষিণের ইন্ডাস্ট্রির চেনা মুখ এই রাজীব। ভারতীয় সিনেমার দীর্ঘ যাত্রাপথের অন্যতম শরিক তিনি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন একটা বদল। অন্তত তাঁর আশঙ্কা সেদিকেই নির্দেশ করছে। রাজীবের কথায়, একটা সময় দর্শক সিনেমাকে শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবে দেখতেন। তবে আজ তাঁদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই বর্তমানে তাঁর কাছে এ দেশের দর্শক, আর যাই হোন সহিষ্ণু নন। মানে সিনেমায় কিছু দেখানো হল আর সেটা স্রেফ বিনোদনের কথা ভেবেই তাঁরা দেখলেন, এমনটা হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। তাই অশান্তি হবে, হচ্ছেও। সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘ছাওয়া’ সিনেমাই তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। সিনেমায় দেখানো ইতিহাসকে সত্যি ধরে, রীতিমতো হিংসার আবহ তৈরি করেছেন অনেকে। তাতে সমস্যা বাড়ছে বই কমছে না। তাও এ সিনেমায় যেভাবে হিন্দুত্ববাদের জয়গান গাওয়া হয়েছে, তাতে সিনেমাহলে ভাংচুর করার অবকাশ ছিল না। তাই বলে এমন ঘটনা যে হয়নি, তা নয়। একদিকে সিনেমায় দেখানো ইতিহাসকে সত্যি বলে যেমন অশান্তি ঘনিয়েছে, অন্যদিকে তেমনই সিনেমায় দেখানো ইতিহাস একেবারে ভুল, এই দাবিতেও বিরোধ হয়েছে। পদ্মাবত, কেরালা স্টোরি, এমপুরাণ, তালিকা নেহাতই ছোট নয়। এইসব সামনে থেকে দেখেই রাজীবের আশঙ্কা, এইসময় বোম্বে রিলিজ করলে হয়তো সিনেমাহল জ্বালানো হত।
তাঁর আশঙ্কা যে একেবারে ভুল একথা জোর গলায় বলা যায়? সিনেমা জগতের কলাকুশলীরাই হলফ করে তা বলতে পারবেন না। বিগত বছরে এমন ঘটনার সংখ্যাও কম নয়, যেখানে সিনেমার জন্য আক্রান্ত হতে হয়েছে অভিনেতা বা পরিচালককে। সিনেমা বয়কটের ডাক উঠেছে, সিনেমাহলে ভাংচুর অবধি চলেছে। অথচ এ দেশেই তামিল ভাষায় সবথেকে বানিজ্য-সফল ছবির তকমা পেয়েছিল ‘বোম্বে’। মাঝের এই ২৫-৩০ বছরে এতটাই বদলে গেল দেশ কিংবা দর্শকদের মন মানসিকতা যে এমন ছবি দেখা দূর সহ্য করাই কঠিন হয়ে গেল তাঁদের কাছে! প্রশ্ন রাজীব মেননের। এবং প্রশ্নের আড়ালে লুকিয়ে রাখা এক চাপা আক্ষেপ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বোম্বে তৈরির খুঁটিনাটি বলতে গিয়েই এমন আক্ষেপ শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। হয়তো ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরও ঘটবে। যেভাবে রাজীব আক্ষেপ করলেন, সেই আক্ষেপ হয়তো ঝরে পড়বে এমন অনেক কিংবদন্তির গলা থেকে, যা আজ ভাবাও যায় না। তবু আশায় বাঁচে চাষা! স্বপ্ন দেখা নিয়েই এগিয়ে যাওয়া। যে দেশ একসময় বিনোদনকে স্রেফ বিনোদনের মতোই দেখত, সিনেমায় দেখানো বয়ান কখনও হিংসার কারণ হয়ে উঠত না, আগামীতেও হয়তো তেমনটাই হবে, ফের।