তিনি ঈশ্বর। তিনি পৃথিবী। তিনি আমাদের ভালোবাসা। শচীন তেণ্ডুলকর। যে নামের সামনে নতজানু ভারতবাসী। আগেও ছিল, এখনও আছে। গোটা বিশ্ব যে বিস্ময় প্রতিভাকে স্মরণ করে সম্ভ্রমে। তাঁরই ৫০তম জন্মদিনে সংবাদ প্রতিদিন-এর আয়োজন ‘বাহ্ শচীন’। নিরলস সাধনায় যে সাধক দেশকে এনে দিয়েছেন অনন্ত ঐশ্বর্য, তাঁকেই ফিরে ফিরে দেখা স্বজন, সতীর্থদের চোখে। আসুন মেতে উঠি এই শচীন পার্বণে।
সনাতন দিন্দা: একটা ফোনকলের প্রসঙ্গ ধরেই শচীনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের গল্পটা শুরু করি। সেটা ২০০৯ সাল। আইপিএল চলছে। হঠাৎ প্রাইভেট নম্বর থেকে ফোন পেলাম। উলটোদিকে স্বয়ং শচীন তেণ্ডুলকর। আবদার করে জানাল, দাদা, তোমার আঁকা ‘যুগপুরুষ’ সিরিজের একটা ছবি আমার চাই। স্বয়ং শচীন চাইছে বলে কথা! আমি প্রায় রাতারাতি একটা ছবি তৈরি করে নিয়ে গেলাম ওর কাছে। সেই সময় টিম বেরিয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যেই সময় করে আমার সঙ্গে দেখা করল। ছবিটা ওর হাতে দিলাম। ওর চোখেমুখে তখন অপার বিস্ময় আর আনন্দ খেলা করছে। সুতো, গোলাপের পাপড়ি- এই সিরিজের ছবিগুলোতে যা যা থাকে সবই দেখল খুব মন দিয়ে। তারপর ছবিটা ওর সেক্রেটারি বা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কারও হাতে দিল না। নিজেই হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। শিল্পী হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই সেটা আমার কাছে খুব আনন্দের মুহূর্ত। ঘণ্টা চারেক পরে আবার ফোন এল। বলল, অঞ্জলির সঙ্গে একটু কথা বলো। তখনই জানাল যে, এই সিরিজের ছবি মুম্বইতে ও অনেক খুঁজেছে। পায়নি। নতুন ছবি পেয়ে ওরা খুব খুশি। নতুন বাড়িতে সাজিয়ে রাখবে। আর এই ছবিটা ওর কাছে যে খুব শুভ, সেটাও জানাল। শচীনের সঙ্গে পরিচয়ের শুরুটা ছবির সূত্রেই। তারপর কী করে যেন আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম।
আরও শুনুন: Sachin@50: শচীন স্যরকে প্রথম দর্শনে কেঁপে উঠেছিলাম
আর একটা দিনের গল্প। সেদিন রাখিবন্ধন। আমি পারিবারিক উৎসবে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখি, শচীনের ব্যক্তিগত নম্বর থেকে ফোন আসছে। ততদিনে বন্ধুতা আরও একটু গাঢ় হয়েছে। ব্যক্তিগত ফোন নম্বরও ভাগাভাগি করে নিয়েছি আমরা। সেদিন বেশ খোশমেজাজেই ছিল। আর মুডে থাকলে শচীন বেশ রঙ্গ-রসিকতা করে। সেদিনও একটু ইয়ার্কি-ঠাট্টা হল। তারপর বলল, ওর এক বন্ধু আমার একটা ছবি কিনতে চায়। এটা বলেই বেশ দুষ্টুমি করে বলল, আমি ওকে যে ডিসকাউন্ট দিই, তা যেন আর কাউকে না দিই। ভাবুন! অমন বড় মানুষ, অথচ কী শিশুসুলভ! শুনে তো আমি হাসছি। আসলে সম্পর্কের জায়গাটা আলাদা। কিন্তু একজন শিল্পী হিসাবে আমার শিল্পকর্মের যা মূল্য হওয়া উচিত, তা দিয়েই একজন শিল্পরসিক আমার কাজ কিনবেন- শচীন সেই জায়গাটিই বোঝাতে চাইছিল। আমাদের সম্পর্কটা এমনই, নির্মল বন্ধুতার। আবার একে অপরের কাজের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটিও আছে।
আরও শুনুন:Sachin@50: চাপ সামলানোর ক্ষমতা ছিল ঐশ্বরিক, আমরা শচীনকে দেখেই শিখি
২০১১ সালে তো আমার বাড়িতেও চলে এল। ১৭ নম্ভেম্বর ছিল দিনটা, মনে আছে। আমি তো কোনওদিন ভাবিনি যে শচীনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে। শচীন নিজে খুঁজে আমার ছবি কিনবে, এ তো কল্পনার অতীত। অথচ শচীন এত সহজে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়েছিল যে, বিষয়টি দুজনের কাছেই খুব সহজ হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে ফোন করে জিজ্ঞেস করত, এখন কী কাজ করছ, দেখাও। আমি দেখাতাম মেসেঞ্জারে বা মেল করে। ওর পছন্দ হলে বলত, এই ছবিটা আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও। তারপর ২০১১ সালে বলল, ঘণ্টাখানেক সময় আছে, আমি তোমার বাড়িতে যাব। দিনটা আমার কাছে রীতিমতো স্মরণীয় হয়েই থাকবে। পাঁচতারা হোটেল থেকে চলে এল আমার ফ্ল্যাটে। দুর্দান্ত আড্ডা দিয়েছিলাম আমরা। একঘণ্টা কী করে যে পেরিয়ে গেল, কেউ যেন ঠাহরই করতে পারলাম না। আর শচীন তো আড্ডা ছেড়ে উঠতে নারাজ। বলছে, ঠিক আছে নাহয় ফ্লাইট মিস হবে! অমন গগনচুম্বী প্রতিভাধর একজন ব্যক্তি, অথচ বন্ধুমহলে এমন মাটির মানুষ, এমন আড্ডাঅন্ত প্রাণ যে ভাবা যায় না। আমি তো ঠিক করেই রেখেছিলাম যে, যে-মানুষটা বাইশ গজের পৃথিবীকে শাসন করে, তাঁকে টেনে আনব রং-তুলি-ক্যানভাসের দুনিয়াতেও। ৩ ফুট বাই ৬ ফুটের একটা ক্যানভাস রেডি করে রেখেছিলাম। বললাম, একটা ছবি আঁকবে? ও তো হকচকিয়ে গেল। বলল, আমি কী করে ছবি আঁকব? আমি বললাম, চেষ্টা করেই দেখো না! তুলিটা ক্যানভাসে বোলাও, কিছু একটা তো হবে। তো ও বাধ্য ছেলের মতো সে-ই কাজ করল। তারপর আমি খানিক তুলি ধরলাম। এই করতে করতে শচীন যেন এই আঁকার আনন্দে বুঁদ হয়ে গেল। আর সে কী স্বর্গীয় হাসি তখন ওর মুখে। ওর সেই হাসিমুখের ছবিটা তোলা হয়েছিল, আছে আমার কাছে। ওই হাসিটাই যেন বলে দেয়, নিজের ভিতরে সাধারণ একটা মানুষকে ও কীভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে। পুরো ওই আড্ডা জুড়েই সেটা বোঝা গিয়েছিল। ও যে একজন মহান মানুষ, জগদ্বিখ্যাত লোক, সেই সব ব্যাপার যেন ও মাথাতেই রাখে না। আমাদের বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে দিব্যি খোশমেজাজে গল্প করল। একটু গানবাজনা হচ্ছিল। ও তো প্রায় নাচতে শুরু করে দিচ্ছিল। আসলে ঘরোয়া এই পরিবেশটা ওর খুব ভালো লেগেছিল। ওকে যে কেউ বিরক্ত করছে না এই ব্যাপারটায় ও খুব আনন্দ পেয়েছে। এদিকে আমার বাড়ির চারপাশে তো লোকে লোকারণ্য। ওকে বললাম, সবাইকে ও যদি একবার দেখা দেয়। একটুও আপত্তি করল না। আমাদের বাড়ির বাচ্চাদের নাম ধরে ধরে প্রত্যেককে অটোগ্রাফ দিল। এতটুকু বিরক্তিবোধ বা ক্লান্তি নেই। সন্দেশ এনেছিলাম, ওর জন্য। আয়েশ করে খেল। ওর বাড়ির জন্যও সন্দেশ পাঠিয়ে দিলাম। আমার মনে হয়, এইখানেই শচীনের মহত্ত্ব। এত বড় মাপের মানুষ হয়েও এই যে সহজ-সরল হয়ে থাকা, এ তো খুব সহজ ব্যাপার নয়। অথচ শচীন এটা পারে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পারে। চিত্রকলা বা পেন্টিং নিয়েও ওর খুব আগ্রহ খেয়াল করেছিলাম। ভাস্কর্য নিয়েও নানা কথা জিজ্ঞেস করছিল। এই যে একটা প্রায় অচেনা পৃথিবী সম্পর্কেও অসীম কৌতূহল, জানার আগ্রহ জিইয়ে রাখা মনের ভিতর- এটা খুব বড় ব্যাপার। সেদিন দুজনে যে পেন্টিং করেছিলাম, তাতে দুজনেই সই করে তারিখ দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। এমন একটা বন্ধুত্বে রাঙানো সোনালি দিন তো মনে রাখারই মতো।
আরও শুনুন: Sachin@50: শচীন সর্বোত্তম ক্রিকেট-শিল্পী, ওঁর ব্যাটিং লতা মঙ্গেশকরের গানের মতোই
ওর যখন ৯৯টি সেঞ্চুরি হয়েছে, তখন আমি ওকে একটা শার্ট দিয়েছিলাম, সেখানে ‘টেন’ শব্দটা বদলে লেখা ছিল ‘হান্ড্রেডডুলকর’। একশো সেঞ্চুরির আগাম শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। শচীন যে কত বড় মানুষ, তা তো আমি জানি। তাই আমি ওকে খুব বেশি বিরক্ত কখনোই করিনি। তাই বোধহয় মনের যোগাযোগটা থেকেই গিয়েছে। একবার বলল, তুমি আমাকে নদী নিয়ে একটা স্কাল্পচার-পেন্টিং করে দাও। ওর মেয়ের এই ধরনের ছবি নাকি খুব পছন্দ। সেবার ওর আমার গড়িয়ার বাড়িতে আসার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে কলকাতা পুলিশ অনুমতি দেয়নি। তো আমি ছবিটা নিয়ে গেলাম হোটেলে। সেদিনও একসঙ্গে চা খেলাম, গল্প করলাম। এরপর বহুবার যোগাযোগ হয়েছে। হঠাৎ করেই ফোন করে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ দাদা? আমি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। এই গুণটা ওর বরাবরই আছে। যাকে ও ভালবাসে তার সঙ্গে সম্পর্কটা বজায় রাখে, চূড়ান্ত ব্যস্ততার ভিতরেও। আমাকে ওর নতুন বাড়িতে যেতেও বলেছে অনেকবার। আমি ওর ছেলেমানুষি যেমন দেখেছি, তেমন অধ্যবসায়ও দেখেছি। একজন মানুষকে শিখরে পৌঁছতে গেলে যে কী অধ্যবসায় রাখতে হয়, তা আমি শচীনকে না-দেখলে বোঝা যায় না। আমার মনে হয়, ক্রিকেটে তো ও শিখরে আছে, কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে উত্তরণের যে পর্যায়ে ও নিজেকে উন্নীত করেছে, সেদিকেও বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কারও সঙ্গে কারও তুলনা করতে চাই না, তবে একটা কথাই বলতে চাই, আমার কাছে শচীন এই শতাব্দীর এক বিস্ময়।