তিনি ঈশ্বর। তিনি পৃথিবী। তিনি আমাদের ভালোবাসা। শচীন তেণ্ডুলকর। যে নামের সামনে নতজানু ভারতবাসী। আগেও ছিল, এখনও আছে। গোটা বিশ্ব যে বিস্ময় প্রতিভাকে স্মরণ করে সম্ভ্রমে। তাঁরই ৫০তম জন্মদিনে সংবাদ প্রতিদিন-এর আয়োজন ‘বাহ্ শচীন’। নিরলস সাধনায় যে সাধক দেশকে এনে দিয়েছেন অনন্ত ঐশ্বর্য, তাঁকেই ফিরে ফিরে দেখা স্বজন, সতীর্থদের চোখে। আসুন মেতে উঠি এই শচীন পার্বণে।
সানিয়া মির্জা: পাহাড়প্রমাণ চাপকে অ্যাটলাসের মতো নিজের কাঁধে বইতে বইতে কী করে দিনের পর দিন পারফর্ম করে যেতে হয়, শচীন তেণ্ডুলকরের জীবন যেন তারই পাঠ্যপুস্তক। আমরা অ্যাথলিটরা, বিশেষত নারীরা তাঁর থেকে এটা খুব ভাল করেই শিখে নিতে পারি। একটা মানুষ বছরের পর বছর লোকচক্ষুর সামনে পারফর্ম করে চলেছন। তিনি জানেন তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের খুঁটিনাটি নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ চলবে। মাঠ আর মাঠের বাইরে প্রায় প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর জীবন যে আতশকাচের তলায়, তা তাঁর থেকে ভাল আর কে জানেন! কিন্তু এই চাপের মস্ত বোঝাটিকে তিনি হেলায় বাউন্ডারির ওপারে ফেলে দিতে পারেন। বেগতিক হাওয়ার ভিতরও কী করে সিটবেল্ট বেঁধে রেখে উড়ান জারি রাখতে হয়, তিনি জানেন। জানেন চাপের ভিতর থেকে অনির্বাণ অগ্নিশিখার মতোই জ্বলে উঠতে। আর এই কাজ তো তিনি দু-এক দিন করেননি, করেছেন দীর্ঘ কয়েক দশকের কেরিয়ার জুড়ে। তাঁর জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখলে একটা জিনিসই উপলব্ধি করতে পারি, খেলাটার প্রতি তিনি কতখানি সৎ এবং নিষ্ঠ। প্রায় উপাসনার মতোই তিনি যেন খেলাকে তাঁর আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন। মাঠে যখন তুমি নামছ, তখন পৃথিবী মুছে যায়। একান্তে মুখোমুখি শুধু তুমি আর তোমার আরাধ্য- খেলা। এর বাইরে কিছু নেই। তোমাকে জিততে হবে। দেশের জন্য, দেশের তেরঙ্গার জন্য, সমর্থকদের জন্য আর সবার উপরে নিজের জন্য। শাশ্বত এই শিক্ষা আমরা শচীনের থেকে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে পেয়ে এসেছি। আমার মতো যাঁরাই ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট দেখছি, খেলাটাকে ভালবেসে ফেলেছি তাঁরা যে শচীনে বুঁদ হয়ে থাকব এতে তাই আশ্চর্যের কিছু নেই। তাঁর দিকে বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে থেকেছি আর কত কিছু যে শেখার চেষ্টা করেছি তা লিখে শেষ করা যাবে না।
আরও শুনুন: [email protected]: শচীন স্যরকে প্রথম দর্শনে কেঁপে উঠেছিলাম
তাঁর সমসাময়িকদের থেকে শচীন আলাদা হয়ে যান বোধহয় একটা জায়গাতেই। আমাদের প্রত্যাশার সমস্ত ভার আমরা তাঁর উপর চাপিয়ে দিয়েছি, আর তিনি তা অবলীলায় বহন করেছেন গোটা কেরিয়ার জুড়েই। আমরা চেয়েছি, শচীন ব্যাট হাতে নামছেন মানে সেঞ্চুরি করবেনই। এর থেকে কম হলে আমাদের মন ওঠে না! আমরা তাঁর নাম উচ্চারণ করে উল্লাসে মেতেছি। তিনি নামছেন মানে স্টেডিয়াম জুড়ে উঠছে ‘শচীন শচীন’ ধ্বনি। প্রায় তাঁর কেরিয়ারের গোড়াতেই আমরা তাঁকে চিনে নিয়েছি জিনিয়াস হিসাবে। অতএব জিনিয়াসের জ্যোতির্বলয় থেকে তাঁর আর বেরোনোর উপায় নেই। শচীনের কোনও ভুল জাতি মেনে নেবে না। শচীন নিজে তা জানেন। আর তা জেনে, সেই প্রায় অসম্ভব চাপ মাথায় নিয়েই তিনি বারেবারে জ্বলে উঠেছেন এই ক্রিকেটবিশ্বের সর্বত্র। এই চাপের ভার যে কতখানি নিজে স্পোর্টসম্যান হওয়ার সুবাদে তা ভালই জানি। আর তাই অনুমান করতে পারি, চাপের পাহাড় ঠিক কতখানি ভাঙলে আসে শচীনের মতো সৃষ্টির জোয়ার। উন্মুখ জনজোয়ারের ভিতরও যে শান্ত ঋষিপ্রতিম হয়ে ওঠা যায়, ভিড়ের ভিতর একা ও একান্ত হয়ে ওঠা যায় নিজের খেলার সঙ্গে, তা শচীনকে না-দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ঠিক এই বিন্দুতে এসেই তিনি অনন্ত নক্ষত্রবীথি মাঝে হয়ে ওঠেন ধ্রুবতারা।
আরও শুনুন: [email protected]: স্যরকে দেখব বলে পুলিশের মারও খেয়েছি, শচীন তেণ্ডুলকর আমার ঈশ্বর
সত্যি বলতে, শচীন তেণ্ডুলকর কে? কোটি কোটি ভারতবাসীর নিশ্চিন্ত আশ্রয় তিনি। যদি বলি, আমাদের সকলের মধ্যেই অল্পবিস্তর শচীন আছে, তাহলে হয়তো তেমন বাড়াবাড়ি হবে না। আমরাও তাঁর সঙ্গে ব্যাট করতে নেমেছি, হেঁটেছি, তাঁর সঙ্গে ভেবেছি। আর তিনি যখন নেমেছেন, তখন নিশ্চিন্ত হয়েছি এই ভেবে যে, আমাদের আর কোনও চিন্তা নেই, সব ঠিক আছে। একটা মানুষ নিজেকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে তবে কোটি মানুষের এমন পরম নিশ্চিন্তির জায়গা হয়ে উঠতে পারেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর এই উচ্চতায় পৌঁছেও তিনি যতখানি নম্র, ততখানিই বিনয়ী। আমার মনে আছে, একবার চিকিৎসকদের একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। শচীন ওঁদের বলেছিলেন, আমার খেলায় হয়তো ভুল হয়েও যেতে পারে। কিন্তু আপনাদের কাজ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে বিন্দুমাত্র ভুলের জায়গা নেই। আপনাদের কাজ তাই আমার খেলার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ-কথা কে বলছেন? না, শচীন তেণ্ডুলকর। ঠিক এখানেই মানুষটা সকলের থেকে আলাদা হয়ে যান। তিনি মহীরুহ তবু মাটির মানুষ। শিখরে থেকেও তিনি শিকড়ে। মূল্যবোধ, বিনয়, মর্যাদা, সম্ভ্রম, আভিজাত্যে মোড়া তিনি এমন এক চরিত্র, যা আসলে মহাকাব্যিক। আর এর জন্য কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, আত্মশৃঙ্খলার বাঁধনে যে কতখানি বেঁধে ফেলতে হয় নিজেকে, তা আমি অনুধাবন করতে পারি। আমার সৌভাগ্য যে মুখোমুখি তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। এ-দেশের ক্রীড়াজগতের শ্রেষ্ঠ আইকন তিনি, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারাই ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মতো। এবং এতদিনে একটা কথা জেনেছি, এত সাফল্য, খ্যাতি-জনপ্রিয়তার এমন শিখরে পৌঁছেও শচীন নিজেকে এতটুকু বদলে ফেলেননি। বলেছি তো তিনি হলেন সেই পাঠ্যপুস্তক, যাঁর কাছে জীবনের শিক্ষা নিতে বারেবারে ফিরে যেতে হয়, হয়ই।
শচীন পঞ্চাশে পা দিচ্ছেন। এই অবসরে আমি আমার শৈশবের নায়ককে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।