একপয়সা ট্রামভাড়া বৃদ্ধিতে কলকাতায় একসময় আগুন জ্বলত। এখন সেদিন গিয়েছে। দেশে জ্বালানির মূল্য ১০০ টাকা ছাড়ালেও কোথাও প্রতিবাদের আগুন জ্বলে না। প্রতিবাদের আগুন জ্বলুক না জ্বলুক, সাধারণ মানুষের হেঁশেলে তো আগুন জ্বলেছে! লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
পেট্রোল সেঞ্চুরি হাঁকাল রাজ্যেও। অতিমারীর সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে বেশি আয় কিন্তু পেট্রোল-ডিজেলের উপর চাপানো কর থেকেই। শুধু ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে এই খাতে কেন্দ্রের আয় হয়েছে ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। সাধারণ মানুষের পকেট কেটেই এই টাকা আয় করেছে কেন্দ্র। একপয়সা ট্রামভাড়া বৃদ্ধিতে কলকাতায় একসময় আগুন জ্বলত। এখন সেদিন গিয়েছে। প্রতিবাদের আগুন জ্বলুক না-জ্বলুক, সাধারণ মানুষের হেঁশেলে তো আগুন জ্বলেছে!
দিনকয় আগে আমরা দেখেছিলাম, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান বলছেন, জ্বালানির (Fuel price) উপর সরকার কর কমাবে কীভাবে? ভ্যাকসিন দেওয়ার খরচ তো তুলতে হবে! আসলে মন্ত্রীমশাইকে একথা কেউ স্মরণ করিয়ে দেননি যে, জ্বালানি থেকে কেন্দ্র কর বাবদ একবছরে আয় করেছে ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। যা বিনামূল্যে সমগ্র দেশবাসীকে ভ্যাকসিন দেওয়ার খরচের কয়েকগুণ বেশি।
আরও পড়ুন : পেট্রোলের মন্দ কপাল! CENTURY আছে, SCOREBOARD নেই…
পেট্রোলের সেঞ্চুরি হাঁকানো নিয়ে তা-ও কোনও কোনও মহলে একটু শোরগোল পড়েছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সকলে নীরব ভোজ্য তেলের দৈনন্দিন দাম বৃদ্ধি নিয়ে। ছ’-প্রকার ভোজ্য তেল আমরা সাধারণভাবে ব্যবহার করে থাকি। প্রত্যেকটি তেলের দাম ৫০ শতাংশের উপর বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১১ বছরে কখনও ভোজ্য তেলের দাম এত বাড়েনি। দেশের একেবারে দরিদ্রতম মানুষটিকেও বাজার থেকে ভোজ্য তেল কিনতে হয়। খাদ্যাভ্যাসের কারণে গ্রামে সরষের তেলের চাহিদা বেশি। শহরে অন্যান্য তেল বেশি চলে। সরষের তেলের দাম বাড়ছে বেশি। অর্থাৎ, গরিব মানুষের উপর আঘাত বেশি। তবুও এই নীরবতা। দাম বৃদ্ধি যেন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।
ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির জন্যও কেন্দ্র দায় চাপাচ্ছে বিদেশের বাজারের উপর। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পরোক্ষভাবে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। এবারও তা ফেলছে। এই অতিমারীর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার যখন জ্বালানির উপর কর থেকে নিজের আয় বাড়িয়েই চলেছে, তখন সাধারণ মানুষকে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সমস্ত পণ্য বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। মাছ-ডিম থেকে আনাজপাতি সবই জ্বালানির ব্যয়বৃদ্ধির কারণে দামি। অতিমারীতে ওষুধের খরচ প্রতি পরিবারে বেড়েছে। সেই ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ৮.৪৪ শতাংশ। এই সময় মহার্ঘ হয়েছে সবকিছু।
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদাসীনতা কেন, তা বোধগম্য নয়। মানুষের আন্দোলন নেই বলে নিঃসন্দেহে সরকারের উপর চাপ কিছুটা কম। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে আমরা যে ধরনের বিক্ষোভ, গণ আন্দোলন প্রত্যক্ষ করে থাকি, ভারতে তা অনুপস্থিত। ভারতের মতোই অতিমারীতে বিধ্বস্ত ব্রাজিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ব্রাজিলের রাস্তায় রাস্তায় এই মুহূর্তে জাইর বলসোনারো সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের দেশের রাস্তায় বিদ্রোহ-বিক্ষোভের আগুন দেখা যায় না। আমাদের দেশে ইদানীং আগুন জ্বলে ধর্ম, জাতপাত, ভাষা, প্রাদেশিকতা ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলনে। নয়াদিল্লির অদূরে একদল কৃষক মাসের পর মাস রাস্তায় বসে আছে। বাকি দেশে তাদের নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। অথচ এই কৃষকরা দিল্লির রাস্তায় বসে যে তিনটি নতুন কৃষি আইন বাতিল করার দাবি করছে, তার একটি হল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুতদারি সংক্রান্ত। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির। কেন্দ্রীয় সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুতদারি সংক্রান্ত আইনটি সংশোধন করে তাকে শিথিল করে দিয়েছে। আন্দোলনকারী কৃষকরা তার বিরোধিতা করছে। এই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মজুতদারি সংক্রান্ত আইনটি সংশোধনের অর্থই হল চাল, ডাল, তেলের মতো কোনও পণ্যের দামের ক্ষেত্রে আর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো সেসব পণ্য মজুত করতে পারবে। দেশে আজ ভোজ্য তেল, ডাল-সহ যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে, সেগুলির পিছনে মজুতদারি বড় কারণ।
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যে আর সরকারের দায়িত্ব নয়, সেকথা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সজোরেই বলতে চায়। পেট্রোল-ডিজেলের দাম নির্ধারণ যেমন কেন্দ্র তেল সংস্থাগুলির হাতে ছেড়ে দিয়েছে, তেমনই অন্যান্য জরুরি পণ্যের দাম ঠিক করাও তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে রাখতে চায়।
ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে মানুষের পকেট কেটে বাড়তি লাভ করুক, তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। এ এক অদ্ভুত চক্র। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ আন্দোলন ছাড়া এই পথ থেকে সরকারকে সরানো সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন : Rabindranath Tagore: ‘১০০০ বছরের পুরনো ডিম’ রবীন্দ্রনাথের পাতে, তারপর…
জ্বালানির উপর কর চাপিয়ে সরকারের বাড়তি আয়ে সাধারণ মানুষের যেমন কোনও উপকার হচ্ছে না, তেমনই ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফায় দেশ বা সমাজেরও কোনও লাভ হচ্ছে না। কারণ ব্যবসায়ীরা তাদের লাভের টাকা দেশে লগ্নি করছে না, যাতে অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। যদি ব্যবসায়ীদের লাভের টাকা লগ্নি হত, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ত, কর্মসংস্থান হত। কিন্তু সেসব কিছুই হচ্ছে না। একদল ব্যবসায়ী মুনাফার টাকা দিয়ে পাহাড় তৈরি করছে। আর সাধারণ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। ধর্ম, ভাষা, জাতপাত, প্রাদেশিকতা ইত্যাদি পরিচিতি সত্তার রাজনীতি ছেড়ে যদি দাম বৃদ্ধি ভোটে ইস্যু করা যায়, তাহলেই মনে হয় একমাত্র সরকারকে নড়ানো সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলি অর্থনৈতিক ইস্যুতে ফিরবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে। যদি সেটা না হয়, তাহলে সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর মানুষের আস্থা কিন্তু কমতেই থাকবে।