শ্রাবণ মাসে মাংস খান? হিন্দু নয়, মুঘলদের মতো আচরণ। ভোটের আগে এই সুরেই এবার রাহুল গান্ধীকে বিঁধলেন নরেন্দ্র মোদি। শুনে নেওয়া যাক।
ফের ভোটের ময়দানে হাতিয়ার আমিষ নিরামিষ দ্বন্দ্ব। আর সেই দ্বন্দ্ব টেনেই হিন্দুত্ববাদের ধুয়ো তুললেন নরেন্দ্র মোদি। নিশানায় স্বাভাবিকভাবেই রাহুল গান্ধী। তবে এবার রাহুলের সঙ্গে লালুকেও একযোগে বিঁধলেন মোদি। নাম না করেই তাঁর দাবি, শ্রাবণ মাসে মাংস খেয়ে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছেন দুই নেতা। এহেন আচরণের জন্য তাঁদের মুঘলদের সঙ্গে তুলনা করতেও ছাড়েননি মোদি।
আরও শুনুন:
আমিষ-নিরামিষে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ! বহু রূপে সম্মুখে ফিরছে জাতের ভাগাভাগিই?
ঘটনার সূত্রপাত যদিও প্রায় বছরখানেক আগে। ২০২৩-এর সেপ্টেম্বর নাগাদ একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, একসঙ্গে মাংস রান্নায় হাত লাগিয়েছেন লালুপ্রসাদ যাদব ও রাহুল গান্ধী। আসলে ইন্ডিয়া জোটের গোড়ার দিকে বিরোধী দলের নেতারা পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য প্রকাশে জোর দিয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতিতেই বিহারে গিয়ে লালুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কংগ্রেস সাংসদ। পারস্পরিক সুসম্পর্কের নিদর্শন হিসেবেই একসঙ্গে রান্নার ছবিও প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু লোকসভা ভোটের মুখে সেই পুরনো কথা টেনেই বিরোধীদের তোপ দাগলেন মোদি। জম্মু কাশ্মীরের নির্বাচনী প্রচার থেকে তাঁর সাফ কথা, আসলে দেশের মানুষকে উত্যক্ত করতেই ওই ভিডিও সামনে আনা হয়েছিল। কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষের ভাবাবেগ কী, তা নিয়ে মাথাই ঘামায় না কংগ্রেস বা ইন্ডিয়া জোট। এই আচরণের জেরে মুঘলদের সঙ্গেও বিরোধী নেতাদের তুলনা টানলেন মোদি। তাঁর বক্তব্য, মুঘলরা কেবল এ দেশে আক্রমণ করেই থামেনি, দেশের মন্দির ধ্বংস না করা পর্যন্ত তারা সন্তুষ্ট হয়নি। একইভাবে এই নেতারাও আসলে শ্রাবণ মাসে এই ভিডিও দেখিয়ে দেশবাসীকে উত্যক্ত করতেই চেয়েছেন বলে দাবি মোদির।
আরও শুনুন:
বাঙালির নাকি মাছ খাওয়া বারণ! কী বলছে পুরাণ?
যদিও মোদি সাফাইয়ের সুরে বলেছেন যে, কে কী খাবে তাতে আইন বাধা দিতে পারে না। কিন্তু তাঁর সমস্ত আক্রমণটিই দাঁড়িয়ে আছে মাংস খাওয়ার ইস্যুকে ভিত্তি করেই। আর দেশের গণতন্ত্রের নিরিখে সেই ভাবনাটিই কিন্তু বেশ সংকটের। কেননা মানুষের খাদ্যাভাসের সংস্কৃতি রাতারাতি তৈরি হয় না। একটি নির্দিষ্ট স্থানের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সেই অঞ্চলের মানুষের খাওয়াদাওয়ার প্রকৃতি নির্ভর করে। এই যে শ্রাবণ মাস বা নবরাত্রিতে নিরামিষ খাওয়ার প্রথা মেনে চলেন দেশের এক অংশের মানুষ, তেমনই আবার বাঙালির পুজোতে আমিষ ভোগ দেওয়ার চলও রয়েছে। একটা বড় দেশ তো ইউনিফর্মের মতো একরঙা হতে পারে না, তার বিভিন্ন প্রান্তে এমন বৈচিত্র্য থাকবেই। সেই বৈচিত্র্যই সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তার গুরুত্ব বাড়ায়, আর সেই বৈচিত্র্যকে স্বীকার করাই গণতন্ত্রের দায়িত্ব। আলাদা আলাদা মানুষ কী খাবেন, কী পরবেন, কী বলবেন, কী ভাববেন, সেই সবটাই এই বৈচিত্র্যের অন্তর্ভুক্ত। সেখানে মোদির এই কটাক্ষ কার্যত ওই বৈচিত্র্যকেই নস্যাৎ করে দিচ্ছে। কেন-না কেউ যদি অন্যের উপর তাঁর খাদ্যাভ্যাস জোর করে চাপিয়ে না দেন, তাহলে তো গণতান্ত্রিক পরিসরে সেই অভ্যাস নিয়ে আপত্তি তোলা চলে না। নিরামিষ খাওয়ার ছবিতে যদি আমিষভোজীরা উত্যক্ত না হন, তবে একই কথা উলটোদিকেও খাটে। আর এই দুই পক্ষই যে একইসঙ্গে একই ভূমিতে দাঁড়াতে পারেন, ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি এবং তার সংবিধান কিন্তু সে কথাই বলে। অথচ তার বিপ্রতীপে নিরামিষ ও আমিষ নিয়ে এই দ্বন্দ্ব সাম্প্রতিক কালে বারে বারেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর তা ক্রমে ক্রমে যে মাত্রায় পৌঁছচ্ছে, তাতে জাত ও জাতিভিত্তিক ফাটলটিই আরও বড় হচ্ছে ক্রমশ। মোদির এই মন্তব্যেও ফের যেন ইশারা মিলল সেই সংকটেরই।