১৯১১ সালের কথা। উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি এক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের খাওয়াদাওয়া ও রান্নার জায়গাকে এই সূত্রে ভাগ করা হয়েছিল। আর একটু এগিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, ১৯১৬ সালে এক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের সভাতে খাওয়ার ভিত্তিতে এই ভাগ স্পষ্ট হচ্ছে। সেই পর্বেই যেন ইঙ্গিত ছিল যে, খাওয়ার ভিত্তিতে আমিষ-নিরামিষের এই বিভাজন ক্রমশ ভারতের বুকে বড় দ্বন্দ্ব হয়েই দেখা দেবে।
সাধারণ ভাবে এতে দোষের কিছু থাকতেই পারে না। কেউ আমিষ খেতে পছন্দ করেন। কেউবা নিরামিষ। এ যদি একান্তই খাবারের পছন্দের ভিত্তিতে হত, তাহলে বলার কিছু থাকে না। কেননা, আমিষ-নিরামিষের এই বৈচিত্রের রসায়ন দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। যে বাড়ির খাওয়া-দাওয়া মূলত আমিষ ঘরানার, সেখানেও সপ্তাহে এক দিন কি দু-দিন নিরামিষ হয়। যাঁরা একান্তই নিরামিষ খান, তাঁরা ভুলেও আমিষের পথ মাড়ান না। খাবারের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এই স্বাধীনতা থাকা উচিত, তা নিয়ে কথা চলে না। তবে, সম্প্রতি আমিষ এবং নিরামিষ দ্বন্দ্বের যে মাত্রা স্পর্শ করেছে, তা আদলতে জাতভিত্তিক সমাজের ভাগাভাগির ফাটলকেই নতুন করে চিহ্নিত করছে।
খাদ্যাভাসের সংস্কৃতি রাতারাতি তৈরি হয় না, এক দিনে তা বদলানোও যায় না। একটি নির্দিষ্ট স্থানের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সেই অঞ্চলের মানুষের খাওয়া-দাওয়ার প্রকৃতি নির্ভর করে। যেমন, এই ভারতবর্ষে বহু অঞ্চলেই ব্রাহ্মণরা নিরামিষ খান। তবে, বাংলার ক্ষেত্রে সে নিয়ম প্রযোজ্য নয়। গোটাকয় মাছকে তো এখানে প্রায় নিরামিষ হিসাবেই গণ্য করা হয়, সেইমতো শাস্ত্রের উল্লেখও আছে। এমনকী ধর্মাচরণের ক্ষেত্রেও এই বিভিন্নতা চোখে পড়ার মতো। বাঙালির পুজোয় আমিষ ভোগ দেওয়ার চল আছে, তা পালনও করা হয়। দেশের অন্যান্য বহু প্রদেশের ক্ষেত্রেই আবার এই রীতি মান্য নয়। খাদ্য সংস্কৃতিতে নিরামিষ-আমিষের এই বৈচিত্র বা দ্বৈততা ছিল; তবে তা একেবারে জল-অচল ভাগ হয়ে ওঠেনি।
-: আরও শুনুন :-
কোবরা, জলঢোঁড়া, চন্দ্রবোড়া… রাজনীতি যেন সর্পমঙ্গল কাব্য
বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে ছিল না, তা নয়। ১৯১১ সালের কথা। উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি এক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের খাওয়াদাওয়া ও রান্নার জায়গাকে এই সূত্রে ভাগ করা হয়েছিল। অনুমান করা যেতে পারে, সামাজিক চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েই দ্বন্দ্ব এড়াতে ছিল সেই পদক্ষেপ। আর একটু এগিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, ১৯১৬ সালে এক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের সভাতে খাওয়ার ভিত্তিতে এই ভাগ স্পষ্ট হচ্ছে। কাছাকাছি সময়েই, রেলের খাওয়া-দাওয়া বা বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতেও এই প্রবণতা ক্রমশ দেখা যাচ্ছিল। অর্থাৎ সেই পর্বেই যেন ইঙ্গিত ছিল যে, খাওয়ার ভিত্তিতে আমিষ-নিরামিষের এই বিভাজন ক্রমশ ভারতের বুকে বড় দ্বন্দ্ব হয়েই দেখা দেবে।
বর্তমান ভারতে তা পত্রপুষ্পেই পল্লবিত হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এক খাবার ডেলিভারি সংস্থা তো রীতিমতো আমিষ ও নিরামিষ খাবারের ডেলিভারির জন্য আলাদা পোশাকবিধি পর্যন্ত স্থির করে ফেলেছিলেন। যদিও তা এখনই চালু হচ্ছে না। তবে, প্রবণতা বলছে, ভাগাভাগির মাত্রা এতটাই যে, কর্পোরেট সংস্থা পর্যন্ত এই বিভাজনকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। অথবা যে বিভাজনের ন্যারেটিভ মাথাচাড়া দিয়েছে তাকেই স্বাভাবিক করে তুলতে চাইছে এমন পদক্ষেপে। ঠিক এই জায়গাতে পৌঁছেই আর আমিষ-নিরামিষ দ্বন্দ্ব আর কেবলমাত্র খাবারের পছন্দের তফাত হয়ে থাকছে না। এর সঙ্গে মিশে গিয়েছে সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত আধিপত্যের বিষয়টিও।
সন্দেহ নেই, জাতিভেদ ভারতবর্ষের গভীরে আজও একই ভাবে রয়ে গিয়েছে। তা মুছে ফেলার যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, প্রগতিশীলতার যত অনুশীলনই চলুক না কেন, সময়ে সময়ে তা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ফিরে এসেছে সাংস্কৃতিক মানচিত্রে। আমিষ আর নিরামিষের সঙ্গেও এর সম্বন্ধ গভীর। সমাজে উঁচু বর্গের জাতি হিসাবে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের খাবারের সংস্কৃতি মূলত নিরামিষ অধ্যুষিত। যদিও স্থানভেদে তার প্রভেদ আছে। তবু একটা গড় অভ্যাস চিহ্নিত করা যায় বইকি! এর সঙ্গে আছে মিশে আছে ধর্মীয় শুদ্ধতার ধারণাও। সেই জাতিধারণার সঙ্গে যাঁরা সাযুজ্য বোধ করেন বা করতে চান, তাঁরা শুধু নিরামিষ খেতে চান তাই-ই নয়, আমিষভোজীদের ঘৃণাও করেন। এই ঘৃণা ক্রমশ বাড়ছে।
-: আরও শুনুন :-
ঘর আলো করুক কন্যাসন্তান, দত্তকের নতুন ঝোঁক চেনাল সরকারি তথ্য
এদিকে এই ভারতে অর্থনৈতিক পার্থক্যও প্রবল। এই সূত্রে শ্রেণির নিরিখে খাদ্যাভাসও বদলে যায়। গরিব সাধারণ মানুষের কাছে আমিষ সহজলভ্য। এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদাও তাতে মেটে। নিরামিষের প্রাবল্যে সেই খাবারের উপরও কোপ পড়ছে বিস্তর। এতে অর্থনৈতিক বিভাজন, যা আদতে আছেই, তা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। ক্রমে দেখা যাচ্ছে, নিরামিষ খাওয়ার প্রবণতা, খাদ্য সংস্কৃতি পেরিয়ে একধরনের স্ট্যাটাসের পরিচায়ক হয়ে উঠছে সমাজে। খেয়াল করার মতো যে, নিরামিষের পক্ষে যাঁরা সোচ্চার, তাঁরা প্রাণীহত্যার যুক্তি তুলে আনেন। তবে, প্রাণীর প্রকারভেদের এই যুক্তিও বদলে যায়। অর্থাৎ সব প্রাণীহত্যাকেই যে একইরকম গুরুত্ব দেওয়া হয় তা নয়। সেখানে মিশে যেতে থাকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নতুন করে ছড়িয়ে দেওয়া বক্তব্যও। খাবারের ছদ্মবেশে এক বিশেষ ঘরানার রাজনৈতিক মতবাদই যেন ফালাফাল করতে চাইছে বৈচিত্রের সমাজকে।
নিরামিষ-আমিষের বর্তমান বিভাজন তাই একেবারে অন্য একটি মাত্রা ছুঁয়ে যাচ্ছে। তা মূলত জাতপাত, সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং অর্থনৈতিক বিভাজনের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। আর সেখানেই দেখা দিচ্ছে প্রশ্ন। পছন্দসই খাবারের বিভিন্নতা যে কোনও সমাজের ক্ষেত্রেই মেনে নেওয়া সহজ সত্য। তবে তা যখন বহু মাত্রায় বিভেদকে প্রশ্রয় দেয় তখন তার ভিতরকার অভিপ্রায়টি চিনে নেওয়া দরকার হয়। বলা যায়, নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় অস্পৃশ্যতার নতুন অস্ত্র হয়েই দেখা দিচ্ছে এই প্রবণতা। সুতরাং এই দ্বন্দ্বকে প্রশ্ন না করেও উপায় নেই।