নেতাজিকে নিশানা করে বন্দুক তাক করেছেন ব্রিটিশ বাহিনীর এক অফিসার। মুহূর্তে নেতাজিকে আড়াল করে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক নারী। সোজা বেয়নেট ঢুকিয়ে দিলেন ওই সেনার পেটে। মাটিতে আছড়ে পড়ল দেহটা। ছিটকে এল তাজা রক্ত। হাতে লাগা রক্তের সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে চোখের জলটুকুও মুছে নিলেন সেই নারী। তিনিই জানেন, এই মুহূর্তে তিনি যাকে হত্যা করলেন, সেই সেনা আর কেউ নন, তাঁর নিজেরই স্বামী।
এই একটা লোককে শেষ করে দিতে পারলেই অনেক, অনেকখানি নিশ্চিন্ত হবেন ব্রিটিশ প্রভুরা। এই একজন মানুষই দিনের পর দিন তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন। ইনি আবেদন নিবেদনের ধার ধারেন না, কোনও অহিংসা আন্দোলনের প্রতিও তাঁর আস্থা নেই। তার বদলে বোমা গুলি বন্দুক নিয়ে সরাসরি ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন তিনি। আর দেশের মানুষগুলোও যেন খেপে উঠেছে। অবশ্য সবাই নয়। ভাগ্যিস। এই জয়রঞ্জনের মতো লোকও তো আছে। ব্রিটিশ সেনায় নিশ্চিন্ত চাকরি। দেখতে দেখতে অফিসারের র্যাঙ্কও জুটে গিয়েছে। ঝকঝকে উর্দি আর চকচকে অস্ত্র, সঙ্গে মোটা বেতন, আরামের কমতি নেই। আর এই মানুষটাকে মারতে পারলে এবার তাঁর পদোন্নতি আটকায় কে! এইসব ভাবতে গিয়েই বোধহয় নিশানা সরে গিয়েছিল একটু। গুলিটা ছুটল ঠিকই, কিন্তু একটুর জন্য লক্ষ্যে বিঁধল না। যাঁকে মারার জন্য বন্দুক তাক করেছিলেন ইংরেজ সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস, তিনি আর কেউ নন, ব্রিটিশ বাহিনীর ত্রাস, খোদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নেতাজির বদলে নেতাজির গাড়ির চালককে ফুঁড়ে দিল গুলিটা। দ্রুত পরের গুলিটা করার জন্য ট্রিগারে হাত রেখেছিলেন জয়রঞ্জন। কিন্তু তার আগেই তাঁর চোখের সামনেটা কেমন অন্ধকার হয়ে এল। পেটের কাছটা ভেজা ভেজা ঠেকছে… সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা… বন্ধ হয়ে আসা দুচোখের সামনে খুব পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেলেন তিনি। এক তরুণীর সুন্দর মুখ। অস্ফুটে বললেন, ‘নীরা!’ তারপরেই আছড়ে পড়লেন মাটিতে। রক্তে ভিজে গেল জায়গাটা। আর কঠিন মুখে সেনা অফিসারের পেটে বিঁধিয়ে দেওয়া বেয়নেটটা বের করে নিলেন নীরা আর্য। রক্ত ছিটকে এসে লেগেছে তাঁর হাতেও। নির্বিকার মুখেই হাতটা মুছে নিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসির রানি রেজিমেন্ট-এর এই সদস্যা। তাঁর মুখ দেখে আঁচ পাওয়াও শক্ত যে তাঁর মনের মধ্যে কী তোলপাড় চলছে। কিন্তু নেতাজি জানেন, এইমাত্র নিজের হাতেই নিজের সিঁদুর মুছে ফেলেছেন এই নারী। ইংরেজ সেনার যে অফিসারটিকে এই বীরাঙ্গনা নিজের হাতে খুন করলেন, সেই অফিসার আসলে তাঁর নিজেরই স্বামী। অভিভূত সুভাষ সেদিনই তাঁর নাম দিলেন ‘নাগিনী’।
আরও শুনুন: অস্ত্র যখন যৌনতা! শরীরের ‘টোপ’ দিয়েই অসংখ্য নাৎসি সৈন্যকে ঘায়েল করেছিল এই কিশোরী
রাজনীতির ভাষায় তিনি গুপ্তচর। হ্যাঁ, আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর ছিলেন নীরা আর্য, এমনটাই মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। নেতাজির এতখানিই আস্থা অর্জন করেছিলেন নীরা যে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার বর্তেছিল তাঁর উপরে। স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ধরা পড়লে নিজেরাই নিজেদের গুলি করতে হবে। নীরা জানিয়েছেন, তাঁদের দলের একজন, দুর্গা, তা করতে পারেনি। ইংরেজরা তাকে জীবন্ত ধরে ফেলে। এর ফলে দলের গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় পেয়েছিলেন সকলেই। সেই সময়েই নীরা এবং রাজামণি, দুজনে এক বিপজ্জনক অভিযান শুরু করেন। যে কোনও উপায়েই হোক, দুর্গাকে ফিরিয়ে আনবেন বলে ঠিক করেন তাঁরা। নপুংসক নর্তকীর পোশাক পরে তাঁরা পৌঁছে যান ব্রিটিশ শিবিরের কাছে। সৈনিকদের লালসার সুযোগ নিয়ে তাদের বেহুঁশ করে দেন মদের নেশায়। কিন্তু দুর্গাকে নিয়ে পালানোর সময় পাহারাদার সৈন্যরা সজাগ হয়ে যায়। দুর্গাকে নিয়ে গাছে উঠে লুকিয়ে পড়েন নীরা। ব্রিটিশদের তল্লাশি থেকে বাঁচতে তিনদিন ধরে সেখানেই ছিলেন তাঁরা। না ছিল খাবার, না জল। রাজামণির পায়ে গুলিও লেগেছিল এরই মধ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পেরেছিলেন তাঁরা। এই সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে রাজামণিকে আইএনএর রানি ঝাঁসি ব্রিগেডে লেফটেন্যান্ট এবং নীরাকে অধিনায়কের পদ দিয়েছিলেন নেতাজি।
আরও শুনুন: দেশ ছাড়ার ভাবনা নেতাজির, পাউরুটির মধ্যেই গোপন খবর পৌঁছে দিতেন সাবিত্রী দেবী
১৯০২ সালে উত্তরপ্রদেশে জন্ম নীরার, কিন্তু ব্যবসায়ী পিতার কাজ ছিল কলকাতায়। তাই নীরার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল এই শহরেই। হিন্দি, ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি আরও অনেক ভাষায় দক্ষ ছিলেন তিনি। আর দেশের প্রতি তেমনই প্রবল ভালবাসা ছিল তাঁর। তাই সিআইডি ইন্সপেক্টর শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সঙ্গে বিয়েটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। নেতাজির পিছনে নজরদারির দায়িত্ব ছিল এই অফিসারের, নির্দেশ ছিল তাঁকে হত্যা করারও। কিন্তু স্বামীর এই চাল ব্যর্থ করতে গিয়ে তাঁকে হত্যা করতেও সেদিন পিছপা হননি নীরা আর্য। যদিও এই ঘটনার জল গড়িয়েছিল আরও অনেক দূর। আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করার পরে সমস্ত বন্দি সৈন্যকে দিল্লির লাল কেল্লায় বিচারে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বামীহত্যার কারণে দ্বীপান্তরের সাজা পান নীরা। জেলে বন্দিদশায় তাঁকে অকথ্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু কোনোরকম সরকারি সহায়তা বা পেনশন গ্রহণ করেননি। হায়দরাবাদে একটি কুঁড়েঘরে থেকে, ফুল বিক্রি করেই একাই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন নেতাজির ফৌজের এই বীরাঙ্গনা নারী, নেতাজি যাঁকে চিনতেন ‘নীরা নাগিনী’ বলেই।