কার্ল মার্কস। ১৮১৮ সালে ৫ মে যে মানুষটা পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন, তাঁর ভাবনা এবং দর্শনকে ভর করেই আজও পৃথিবী বদলানোর স্বপ্ন দেখেন বহু মানুষ। মার্কসীয় দর্শনের প্রয়োগজনিত ভুলভ্রান্তি নিয়ে এখন গোটা বিশ্ব জুড়েই আলোচনা। আর সেই আলোচনা যত বাড়ছে, তত আমরা নবরূপে আবিষ্কার করছি মার্কসকে। বিশেষত তরুণ বয়সের মার্কসকে। খুঁজে পাচ্ছি তাঁর জীবনের নানা দিক। মার্কস যে অল্প বয়সে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন, অনেক অনেক ভাবনার ভিড়ে, এ-কথাটি আমরা প্রায়শই ভুলে যেতে বসি। তবে অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, মার্কস শুধু সমাজ-বিজ্ঞানী বা দার্শনিকই ছিলেন না, একজন কবিও ছিলেন।
তরুণ মার্কস বনাম প্রবীণ মার্কসের (Karl Marx) একটি চলতি দ্বন্দ্ব, অনেক সময়ই কার্ল মার্কস সংক্রান্ত আলোচনায় চলে আসে। মার্কসীয় ভাবনার নানা দিক কীভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল তার একটা হদিশ পাওয়া যায় এই আলোচনা থেকে। অনেক সমালোচকই আবার এ দ্বন্দ্বটিকে সেভাবে আমল দিতে চান না। তবে না, সেই প্রসঙ্গে না গিয়েই আপাতত আমরা তরুণ মার্কসের দিকেই এই অবসরে ফিরে তাকাব।
সেই মার্কস (Karl Marx), যিনি নিজের কেরিয়ার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথাগত ধর্মের ভিতরকার মহান ভাবটিকেও পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বুঝছিলেন, ধর্ম কীভাবে মানুষকে আত্মত্যাগের মহান শিক্ষা দেয়। সুতরাং নিজের জন্য তিনি এমন একটা কাজের কথাও ভাবছিলেন, যা শুধু তাঁর একার উপকারে লাগবে না, বরং সেই কাজের হেতু সমগ্রেরও উপকার হবে। মার্কসের ভাবনা যেমন আমাদের আন্দোলিত করে, পুঁজিচালিত সমাজব্যবস্থাকে চুলচেরা বিশ্লেষণে, নিজেদের অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্য করে, ঠিক সেভাবেই তরুণ মার্কসের (Karl Marx) এই মন ও মনন আমাদের সামগ্রিক ভাবে মার্কসকে চিনে নিতেও সাহায্য করে।
আরও শুনুন: ধর্মপরিচয় প্রধান নয়, তিনি বাঙালি… স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন বাঙালির আইকন সত্যজিৎ
তরুণ মার্কস ছিলেন একজন কবি। তাঁর জীবন ও লেখা নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন যে গবেষকরা, তাঁরা জানাচ্ছেন, অন্তত ১৬৪টি কবিতা লিখেছিলেন মার্কস। তখন তাঁর বয়স নেহাতই অল্প। এর মধ্যে বেশ কিছু কবিতা আবার ছিল জেনির প্রতি। প্রত্যাশিত ভাবেই, একসময় মার্কসের এইসব কবিতাকে অল্প বয়সের ভাবালুতা বা অপরিণত কাজ বলে খানিকটা দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন গবেষকরা। মার্কসের (Karl Marx)সমাজ সংক্রান্ত ভাবনা বা মার্কসের পুঁজি বিশ্লেষণের সূত্রাবলি যেভাবে পৃথিবীকে আন্দোলিত করেছে, সেভাবে মার্কসের কবিতা নিয়ে চর্চা হয়নি। এর কারণ এই নয় যে, মার্কস কবি হিসাবে দুর্বল ছিলেন। সে অবশ্য আলাদা বিচারের বিষয়। কিন্তু ঘটনা হল, মার্কসের যে প্রধান কাজ, তাই-ই আসলে ঢাকা দিয়ে দিয়েছিল সেদিনের তরুণ কবি মার্কসকে।
আরও শুনুন: উজ্জ্বল স্বীকৃতি! বুকার পুরস্কারের জন্য প্রথমবার মনোনয়ন পেল ভারতীয় ভাষার উপন্যাস
পরবর্তীতে মার্কসের (Karl Marx) লেখাপত্তরকে যখন বহুকৌণিক দিক থেকে দেখা শুরু হয়েছে, তখন কিন্তু গবেষকরা তাঁর কবিতাকে আর দূরে সরিয়ে রাখেননি। কবিতা হিসাবে মার্কসের লেখা কতটা সার্থক, সে কথা নয়, এখানে গবেষকদের টেনেছে তরুণ মার্কসের মন। জানা যায়, একসময় কবিতাচর্চাকে যথোপযুক্ত গুরুত্বই দিয়েছিলেন মার্কস। সেই সময় কবিদের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগও ছিল। আপাতভাবে তাঁর কবিতা প্রেমের কবিতা মনে হলেও, কেবলই ভাবালু প্রেমের কবিতা তা ছিল না। বরং সেই কবিতার ছত্রে ছত্রে ছন্দের আড়ালে উঁকি দিচ্ছিল এক তরুণের পৃথিবীকে দেখার অন্য দৃষ্টিভঙ্গি। প্রকৃতি, পরিবেশ, নিজের চারপাশ, সমকালের ঘটনাবলিকে মার্কস যে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গেই দেখছিলেন, তারই চিহ্ন ধরে আছে তাঁর কবিতাগুলি। কখনও কখনও স্বগতোক্তির ঢঙে মার্কস তাঁর জীবনবীক্ষা প্রকাশ করেছিলেন কবিতায়। এই পৃথিবীতে একজন মানুষের নিজস্ব যে সংগ্রাম, ভিতরকার যে সংগ্রাম তার আদল ধরা পড়ছিল সেই সময়ের কবিতায়। অর্থাৎ রোম্যান্টিক গোত্রের হলেও মার্কসের কবিতা কেবল প্রেমের ভিতর আটকে থাকেনি। বরং প্রসারিত হয়েছে তার পরিধি। সমাজ ও মানুষকে তরুণ মার্কস যে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তাঁর ভাবনায় যে এই সংক্রান্ত নানা রূপ ফুটে উঠছিল, এই চিহ্নগুলিই বহন করছে তাঁর কবিতা।
আধুনিক গবেষকদের কাছে এইটিই মূল আগ্রহের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবি মার্কস (Karl Marx) হয়তো দুনিয়া কাঁপানো ব্যক্তিত্ব নন, কিন্তু যে মার্কসকে আমরা চিনি, তাঁর যে ভাবনা পৃথিবীকে নতুন আলো দেখায়, সেই ভাবনার আকর যে খানিকটা তাঁর কবিতাতেও রাখা আছে, সেটিই মার্কসকে চিনতে অনেকটা সহায়ক হয়ে ওঠে। সহায়ক ওঠে তাঁর দর্শনকে বুঝতেও। আর তাই কবি মার্কসকে আজ যদি আমরা চিনে নিই, তবে লাভ বই ক্ষতি কিছু নেই।