পঁচাত্তর বছর কেটে গিয়েছে। দেশ ভাগের ক্ষত দগদগে আজও। কোনও মলমই প্রলেপ লাগাতে পারেনি তাতে। বরং যত দিন গিয়েছে ততই গভীর হয়েছে ক্ষত। হিন্দুস্থান-পাকিস্থান দ্বন্দ্বে পরিজনহারা হয়েছেন বহু মানুষ। ঘর-সংসার, দেশ হারিয়ে সর্বহারা হয়েছেন কেউ কেউ। আজও সেই সংঘাত থামেনি। ভারত-পাক সীমান্ত আজও তেতে ওঠে মাঝেমধ্যেই। চলে গুলি-গোলা, ক্ষতের উপরে আরও ক্ষত এসে জমে। একদিন যা ছিল একটিই মাত্র ভূখণ্ড, সেই দু’দেশ আজ প্রতিপক্ষ। অথচ দু’দেশেরই সাধারণ মানুষই চান শান্তি। আর সেই শান্তি ফেরাতেই গত সাতাশ বছর ধরে এক অভিনব মেলার আয়োজন করে আসছে পঞ্জাবের অমৃতসর। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই মেলার গল্প।
সিনেমার পর্দা হোক কিংবা খেলার মাঠ, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব যেন এক চিরচর্চিত বিষয়। ক্রিকেট প্রিয় হোক বা না-হোক, বাইশ গজে ভারত-পাকিস্তানকে যুযুধান দেখতে আজও রক্তগরম হয়ে ওঠে আমজনতার। স্পোর্টসম্যান স্পিরিটকে ছাপিয়ে তখন কথা বলতে থাকে জাতীয়তাবাদ। সীমান্তেও দু-দেশের মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকে সবসময়ে। কখনও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে এ পক্ষ, কখনও অন্যদল। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবন কাটে ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে। দু-দেশের সংঘাত মিটুক, এটুকুই চান তাঁরা। কার্গিল যুদ্ধ থেকে শুরু করে সার্জিকাল স্ট্রাইক, ভারত-পাক দ্বৈরথের বহু ঘটনা আজও জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে।
আরও শুনুন: জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেই শুরু হয় প্রতিদিনের কাজ, দেশপ্রেমের অনন্য নজির এই গ্রামে
তবে একদিকে যেমন সংঘাত রয়েছে, শান্তিকামী মানুষের সংখ্যাও কম নেই দু’দেশে। আর সেই জায়গা থেকেই প্রতিবছর পঞ্জাবের অমৃতসরে আয়োজন করা হয় এক আশ্চর্য মিলনোৎসবের। স্থানীয়রা বলেন, ‘হিন্দ-পাক দোস্তি মেলা’। গত সাতাশ বছর ধরে এ নিয়মের অন্যথা হয়নি কখনও। প্রতিবছর অগস্ট মাসের ১৪ তারিখ শুরু হয় মেলার। দু’দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক হোক স্বাভাবিক ও সুন্দর। এইটুকুই শুধু চাওয়া। আর সেটুকু নিয়েই গত সাতাশ বছর ধরে চলছে আশ্চর্য এই সম্প্রীতির মেলা।
আরও শুনুন: হর ডিশ তিরঙ্গা… স্বাধীনতার উদযাপনে সমস্ত খাবারই জাতীয় পতাকার রঙে সাজাল রেস্তরাঁ
দেশভাগের সময় থেকেই দু-দেশের মধ্যে রয়ে গিয়েছে অমীমাংসিত কিছু সমস্যা। সেই ক্ষোভ রয়ে গিয়েছে দু-পক্ষেরই। তবে স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগের দিন সেই সমস্ত ক্ষোভ আর যন্ত্রণার স্মৃতি ভুলিয়ে কাছাকাছি আসেন দু-দেশের মানুষ। উদ্দেশ্য একটাই, সম্পর্ক হোক আরও একটু সহজ। সেই মেলায় অংশ নেন দু-দেশের বুদ্ধিজীবীরাই। উপস্থিত থাকেন সাংবাদিক থেকে শিল্পী অনেকেই। হিন্দ-পাক দোস্তি মঞ্চ, সাউথ এশিয়া ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ফোকলোর রিসার্চ অ্যাকাডেমি। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। সকালটা শুরু হয় এই সংক্রান্ত একটি সেমিনার দিয়ে। তার পর সারাদিন ধরে চলে নানা অনুষ্ঠান। এ বছর একটি বিশেষ সুফি জলসার আয়োজন করা হয়েছে সেখানে। পাশাপাশি দেশভাগ ও দাঙ্গায় নিহত ১০ লক্ষ মানুষের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানোরও কথা রয়েছে অনুষ্ঠানে। মধ্যরাত্রে আটারি-ওয়াঘা সীমান্তে জ্বালানো হবে মোমবাতি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন দুদেশের প্রতিনিধিরাই। দেশভাগের দগদগে স্মৃতিকে ভুলিয়ে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক বজায় থাকুক দু-দেশের মধ্যে। সেই বার্তা নিয়েই এ বছর সাতাশ বছরে পা দিয়েছে মেলা। আয়োজক থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা সকলেই একবাক্যে মেনেছেন, এ যেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। যা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।