ইদানীং প্রায়শই আমরা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের কথা শুনতে পাই। নানা মাধ্যম, নানা কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় সেই টাকা। না, জোর করে নয়। খুশি হয়ে, ভালবেসে যে যতটা দেন, ততটুকুই। তবে ক্রাউড ফান্ডিং শব্দের রমরমার বহু আগেই বলিউড দেখেছে ক্রাউড ফান্ডিং কাকে বলে। এমন ছবিও বলিউডে হয়েছে, যার জন্য টাকা ঢেলেছেন কয়েক লক্ষ কৃষক। কী সেই সিনেমা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সিনেমা মানেই বড় বাজেট। প্রযোজকদের পায়ে পায়ে ঘোরা চিত্রনাট্য নিয়ে। কিন্তু এমন ছবিরও সাক্ষী থেকেছে বলিউড, যেখানে প্রযোজকদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পাঁচ লক্ষ কৃষক। ভাবতে পারেন? শুধুমাত্র বলিউডেরই নয়। গোটা পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসে সে ছিল নজিরবিহীন এক ঘটনা। প্রথম ক্রাউড ফান্ডেড চলচ্চিত্র হিসেবে আজও সেই স্থান দখল করে রয়েছে ছবিটি।
শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মন্থন’ নামে ওই ছবি জিতে নিয়েছিল জাতীয় পুরস্কারও। যেখানে অভিনয় করেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, স্মিতা পাতিল, অমরিশ পুরী, গিরিশ কারনাডের মতো বড় ও নামী অভিনেতারা। ভাবলে অবাক লাগে, সেই ছবির জন্যই কোনও নামী প্রযোজক পাননি শ্যাম বেনেগাল। পাননি, কারণ ছবির বিষয়বস্তু।
আরও শুনুন: স্তন ছোট বলেই বাদ পড়েছেন সিনেমা থেকে, বলিপাড়ার গুপ্তকথা ফাঁস করলেন রাধিকা
১৯৭৬ সালের সেই ছবির মূল বিষয়বস্তু ছিল আমূল সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ভার্গিস কুরিয়েনের লড়াই। যিনি ভারতীয় ইতিহাসে আজও শ্বেত বিপ্লবের জনক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছেন। গুজরাতে গোয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষের অভাব ছিল না কোনও কালেই। তবে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করার দরকার ছিল বৈকি। আর সেই কাজটাই করে দেখিয়েছিলেন কুরিয়েন। একাধারে তিনি ছিলেন চিকিৎসকও। তবে কো-অপারেটিভ বা সমবায় ভিত্তিতে দুধ উৎপাদন যে এভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আমূল পাল্টে দিতে পারে তা বুঝেছিলেন কুরিয়েন। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় ‘অপারেশন ফ্লাড’। ছবিতে কুরিয়েনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন গিরিশ কারনাড। কুরিয়েনের এই কাজে সাহায্য করেছিলেন ত্রিভুবনদাস কিশিভাই প্যাটেল নামে এক স্বাধীনতা সংগ্রামী। গুজরাতের খেড়া জেলার কৃষকদের নিয়ে সমবায় গড়ে তুলতে তিনি সব দিক দিয়ে সাহায্য করেছিলেন কুরিয়েনকে। তাঁদের মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠল দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র। মাঝখানের ফড়েদের সরিয়ে কৃষকদের সঙ্গে বাজারের সরাসরি যাতে যোগাযোগ হয়, সেই ব্যবস্থাই করেছিলেন কুরিয়েন।
আরও শুনুন: স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর উপার্জনই বেশি, বলিউডের বেতন বৈষম্যকে উড়িয়ে দিয়েছেন এই তারকা দম্পতিরা
তা এহেন কুরিয়েনকে নিয়ে তৈরি ছবির পিছনে টাকা ঢালতে রাজি হননি কোনও বড় প্রযোজকই। সমস্যার সমাধান করে দেন খোদ কুরিয়েন। একদিন বেনেগালকে ডেকে তিনি প্রশ্ন করেন, ছবিটি করতে ঠিক কত টাকা প্রয়োজন তাঁর? বেনেগাল জানান, কম করে হলেও দশ থেকে বারো লক্ষ টাকা তো লাগবেই।
কুরিয়েনের সমবায়ের সদস্যদের ডেকে তিনি জানান সমস্যার কথা। সে সময় দুধের প্যাকেট বিক্রি হত ৮ টাকায়। এক দিন বিকেলের বৈঠকে কুরিয়েন জানালেন, কোনও এক সকালে যদি কৃষকেরা ৮ টাকার পরিবর্তে ৬ টাকায় দুধ বিক্রি করতে রাজি থাকেন, তা হলেই উঠে আসতে পারে ছবি তৈরির টাকাটুকু। সানন্দে রাজি হয়ে যান কৃষকরা। পাঁচ লক্ষ কৃষক রাতারাতি হয়ে ওঠেন বেনেগালের ওই ছবির প্রযোজক। যা বোধহয় বিশ্বের ইতিহাসে কখনও হয়নি।
খুব বেশি না হলেও সামান্য কিছু লাভের মুখও দেখেছিল বেনেগালের ওই ছবি। সম্মান যে পেয়েছিল, তা তো বলাই বাহুল্য। এখনও পর্যন্ত সামান্য যে কয়েকটি ছবি দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা বা চিনের মতো জায়গায় প্রদর্শিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এই ‘মন্থন’। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুরারজি দেশাই নিজে সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছে দিয়েছিলেন ছবিটিকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভাতেও দেখানো হয়েছিল ছবিটি। ভাবা যায়, বলিউডে তৈরি একটি ছবি, যা তৈরি করতে কিনা এগিয়ে এসেছেন কয়েক লক্ষ কৃষক। এমন ঘটনা বোধহয় ইতিহাসে নজিরবিহীন।