অরিজিৎ বাঙালির সেই চির জাগরূক ঐতিহ্যের আধুনিক সলতে। যে আগুনের পরশমণিতে শুদ্ধ হয় দেশ, অথচ তার জন্য বিন্দুমাত্র অহং থাকে না মনে। এই ভোগসর্বস্ব দুনিয়ায় অরিজিৎ এক মূর্তিমান দ্রোহ। যিনি জাগতিক সব সাফল্যকে সরিয়ে রেখে, মনের কৃষিকাজে জোর দিতে জানেন। যাঁর জীবনই হয়ে ওঠে আস্ত একটা কবিতা। কিংবা পাঠ্যপুস্তক। যার দিকে তাকিয়ে আমরা শিখতে পারি, এই ভোগের দুনিয়া, এই সাময়িক সাফল্যের আতশবাজি আসলে কিছুই নয়। বরং মানজমিন আবাদ করে সোনা ফলানোই আসল কথা। জন্মদিনে তাই একটু অন্যরকম ভাবে ফিরে তাকানোর প্রয়াস সংগীতশিল্পীর জীবনের দিকে।
অরিজিৎ সিং। শুধু এই নামটুকু উচ্চারণই যেন যথেষ্ট। তাতেই আবেগের ঢেউ ওঠে দেশবাসীর অন্তরে। প্রশ্ন হল একজন গায়ক, বলা ভাল দেশের এই মুহূর্তের সেরা গায়ককে ঘিরে এই যে আবেগের বিস্ফোরণ তা কি শুধুই তাঁর গান শুনে? উত্তর হল, না। তাহলে? অরিজিৎকে সকলে যে বিনা দ্বিধায় সকলে ভালবাসেন, তার অন্যতম কারণ হল, তাঁর সারল্য। সাদামাটা যাপন। খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেও মাটির মানুষ হয়ে থাকার বিরল গুণ।
আরও শুনুন: নামে নয়, প্রণামেই বড় হয় মানুষ… আপনি আচরি ধর্ম শেখালেন অরিজিৎ
বিরলই বটে। এই ‘আমাকে দেখো’র দুনিয়ায় অরিজিৎ যেন এক ব্যতিক্রমী গ্রহের বাসিন্দা। চারিদিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই! অহং আর আত্মপ্রচারের প্রপাত যেন আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। তিলকে তাল করে দেখাতে না পারলে যেন শান্তি নেই! শুধু সেলেবের পৃথিবীই যে এই অহমিকার কক্ষপথে ঘুরছে তা নয়। এমনকী ব্যক্তিমানুষের পৃথিবীও রং বদলে ফেলেছে অনেকখানি। কিন্তু এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল! অরিজিতের দিকে তাকালে মনে হয় ঠিক তার উলটোটাই। একবার কেরিয়ারের কথাটা ভাবুন। রিয়ালিটি শোয়ের মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বেশ আগেভাগেই। সেরার স্বীকৃতি পাননি। তাতে কী! তিনি যখন ফিরলেন সংগীতের দুনিয়ায়, ফিরলেন রাজার মতোই! আসলে, ফিরলেন কথাটা বলা ভুল। তিনি ছিলেনই। ছিলেন তাঁর সাধনায় আর মগ্নতায়। নেপথ্যে থেকে সংগীত পরিচালক প্রীতম চক্রবর্তীর সঙ্গে কত না কাজ করেছেন! আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে কিংবদন্তি মান্না দে-র কথা। অমন উঁচু দরের গায়ক তিনি। কিন্তু যখন শচীনদেব বর্মণের সঙ্গে কাজ করতেন, তখন নীরবে কত মণিমুক্ত তুলে দিয়েছেন অন্য গায়ককে। নিজের পছন্দের গানও হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছেন প্রযোজকের নির্বাচিত গায়ককে। অরিজিৎও যেন নীরবেই চালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সাধনা। সুরের সঙ্গে তাঁর একান্ত সহবাসের সেই দিনলিপি তাঁকে যে নির্লিপ্তি দিয়েছে, তরই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই মঞ্চে মঞ্চে। তাঁর অনুষ্ঠানে জনতা উদ্বেল, তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য রেলস্টেশনে রাতবিরেতে জমা হয় কয়েক হাজার মানুষ। দেশ কেন বিদেশের মাটিতেও দাপিয়ে পারফর্ম করছেন। বলিউডে হেন কোনও নায়ক নেই যিনি চান না যে, তাঁর ছবিতে অরিজিতের একটা গান থাকুক। অথচ সেই মানুষটাই ব্যক্তিগত জীবনে নিপাট সাদামাটা। জিয়াগঞ্জে বাইক নিয়ে ঘুরতে তিনি দ্বিধা করেন না। অটোচালক থেকে রিকশাচালক সবার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলছেন যেন তাঁদেরই বন্ধু তিনি। আসলে বন্ধুই তো। সঙ্গীতের সাফল্য কখনোই তাঁকে শিকড়চ্যুত করেনি। আর তাই রাজার ঐশ্বর্য হাতে নিয়েও সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতে তাঁর দ্বিধা হয় না।
আরও শুনুন: অযথা বিতর্ক জাগাননি, ভালবেসে জাতীয় মঞ্চে গাইছেন বাংলা গান, শ্রোতারা বুঁদ অরিজিৎ ম্যাজিকে
হালফিলের দিনকালে অরিজিতের এই জীবনযাপন আমাদের বিস্ময় জাগিয়ে তোলে। এমনটাও কি সম্ভব! প্রশ্নের ভিতরই অবশ্য উত্তর লুকিয়ে আছে। এমনটা যে সম্ভব তা তো অরিজিতকে দেখেই বোঝা যায়। বরং বলা যায়, এমনটাই হওয়া উচিত। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, কেননা যাপনের এই শৈলীই স্বাভাবিক। বাঙালির ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখলে এই অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়টিতেই চোখ পড়ে। সিম্পল লিভিং হাই থিঙ্কিং- এ যেন বাঙালি শোণিতপ্রবাহে মিশে আছে। বাঙালির সাহিত্য নোবেল পায়, বাঙালির সিনেমা-সংস্কৃতি বিদেশে প্রশংসা লাভ করে। অথচ সে সবের নেপথ্য কারিগররা যে দূর আকাশের তারার মতো হয়ে থাকতেন তেমনটা তো নয়। বরং এই বাংলার মাটিতে তাঁরা চিরকাল মাটির মানুষ হয়েই থেকেছেন। সময় যত বদলেছে বাঙালির মনের মানচিত্রও গিয়েছে বদলে। সাধারণ যাপন আর উচ্চ চিন্তনের সেই দিনকাল ক্রমশ যেন ফিকে হতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র তো দূরের কথা, সর্বভারতীয় স্তরেও বাঙালির মেধাবি বিচ্ছুরণ যত ম্রিয়মাণ হয়েছে, বাঙালি যেন তত নিজের প্রচারে উদগ্রীব হয়েছে। তা যত না কাজে, তার থেকেও বেশি ব্যবহারে। যত না অন্তরঙ্গে, তার থেকেও বেশি বহিরঙ্গে। এই ব্যতিক্রমী দিনকালে অরিজিৎ তাই স্বাভাবিক হয়েও বিস্ময়-বিগ্রহ। আসলে অরিজিৎ বাঙালির সেই চির জাগরূক ঐতিহ্যের আধুনিক সলতে। যে আগুনের পরশমণিতে শুদ্ধ হয় দেশ, অথচ তার জন্য বিন্দুমাত্র অহং থাকে না মনে। এই ভোগসর্বস্ব দুনিয়ায় অরিজিৎ এক মূর্তিমান দ্রোহ। যিনি জাগতিক সব সাফল্যকে সরিয়ে রেখে, মনের কৃষিকাজে জোর দিতে জানেন। যাঁর জীবনই হয়ে ওঠে আস্ত একটা কবিতা। কিংবা পাঠ্যপুস্তক। যার দিকে তাকিয়ে আমরা শিখতে পারি, এই ভোগের দুনিয়া, এই সাময়িক সাফল্যের আতশবাজি আসলে কিছুই নয়। বরং মানজমিন আবাদ করে সোনা ফলানোই আসল কথা। অরিজিৎ তাঁর কাজে আর জীবনে সেই সাধনাই করেন। সেই সাধনার শিখাটিকেই তিনি তুলে ধরেন তাঁর অজস্র অনুগামীর মধ্যে।
খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে মাটির মানুষ হয়ে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তবু বনস্পতির কথোপকথন তো মাটির সঙ্গেই। পাহাড়ের চূড়া যেখানেই পৌঁছাক না কেন, তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ মাটির গভীরেই। অরিজিৎ আধুনিক সময়ের সেই বিগ্রহ, যিনি আমাদের জীবনের সহজ এই সত্যটি বুঝিয়ে দিতে পারেন জীবন দিয়েই। গানের সাত সুর যেমন থাকে পাশাপাশি, তেমনই বহু মানুষের সম্মিলনে অরিজিৎ গড়ে তুলতে পারেন এমন এক পৃথিবী যেখানে মানুষের মধ্যে বিত্তের ভেদ থাকে না। দ্বেষ-বিদ্বেষ থাকে না। থাকে শুধু ভালবাসা। অসাধারণ হয়েও সাধারণ থাকার গৌরব। রাজা হয়েও সন্ন্যাসী অথবা সন্ন্যাসী হয়েও রাজা হওয়ার যে অপার্থিব আনন্দ- তারই আধুনিক নাম বুঝি অরিজিৎ সিং। আমরা তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হই। তাঁর জীবনের গল্প শুনে বিস্মিত হই। তবে কিছু শিখতেও কি পারি না!