কপিল শর্মার শো-এ মশকরা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। কবিগুরুকে অসম্মানের অভিযোগে ফুঁসে উঠেছে বাঙালি। তবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রসিকতা কিন্তু নতুন নয় আদৌ। কবির জীবদ্দশাতেও ঘটেছে তেমন কাণ্ড। সেইসব তামাশাকে কীভাবে গ্রহণ করতেন কবি? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বলিউডে অপমানিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এই অভিযোগে আপাতত নেটপাড়ায় শোরগোল। কপিল শর্মার বিখ্যাত শো-কেই এই অভিযোগে বিঁধেছেন কবি শ্রীজাত। তিনি জানিয়েছেন, ওই শো-এ বঙ্গসন্তান কাজলকে অতিথি হিসেবে পেয়েই ‘রবীন্দ্রনাথের একটি গানকে মশকরার সরঞ্জাম হিসেবে’ বেছে নেওয়া হয়। কবি অবশ্য নিশ্চিত, এই বেছে নেওয়া কোনও আকস্মিক ব্যাপার নয়, চিত্রনাট্য সাজানো ছিল সেভাবেই। তাঁর কথায়, ‘একলা চলো রে’ গানটি নিয়ে কৃষ্ণ অভিষেক যে ব্যঙ্গাত্মক অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তার উদ্রেক করেছেন, তা সম্মান ও শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে বহু দূর চলে গিয়েছে, অন্তত আমার চোখে।” আর এরপরেই এই অসম্মানের প্রতিবাদে আইনি পথে হাঁটার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কবি। তাঁর সঙ্গে শামিল হয়েছেন বাংলার বিনোদুনিয়ার আরও একাধিক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির প্রাণের ঠাকুর, তাঁকে নিয়ে অসম্মানে বাঙালি ক্ষুব্ধ হবে, এমনটা স্বাভাবিকই। তবে এ প্রসঙ্গে এ কথাও মনে পড়ে যে, কবিকে নিয়ে রসিকতা কিন্তু নতুন নয়। জীবদ্দশাতেই বহুবার এমন তামাশার মুখোমুখি হয়েছেন কবি, যা সত্যি সত্যিই সম্মান ও শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। এ কথাও বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সেই বিদূষণের দলে যোগ দিয়েছে বাঙালি নিজেও। যেমন ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কথা। ‘আনন্দ বিদায়’ নামের ব্যঙ্গ-নাটিকায় তিনি লিখছেন জনাকয়েক ভক্তের সংলাপ। সেখানে এক ভক্ত বলছে, ‘এই একবার বিলেত ঘুরে এলেই ইনি P.D. হয়ে আসবেন।’ আরেক ভক্তের প্রশ্ন, P.D. কী? উত্তরে জানা যাচ্ছে, P.D. অর্থ হল Doctor of Poetry। এবার জিজ্ঞাসু ভক্তের মনে প্রশ্ন উঠছে, ‘ইংরেজরা কি বাংলা বোঝে যে এঁর কবিতা বুঝবে?’ উত্তরে তাকে প্রায় ধরাশায়ী করে দিচ্ছে অন্য একজন, ‘এ কবিতা বোঝার তো দরকার নেই। এ শুধু গন্ধ। গন্ধটা ইংরাজিতে অনুবাদ বলে নিলেই হোল।’
-: আরও শুনুন :-
শিল্প অপছন্দ হলেই শিল্পীকে কাটাছেঁড়া! রবীন্দ্রনাথকেও রেহাই দেয়নি ‘শনিবারের চিঠি’
বোঝাই যাচ্ছে, বিদেশে যখন রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, এক বাঙালির সেই যশোলাভকে ঈর্ষাহীন চোখে দেখতে পারেননি বাঙালিদের একাংশই। তারই ফলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপত্তিকর তামাশা জুড়েছিলেন তাঁরা। অবশ্য এত খ্যাতি-যশের আগেও, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তরুণ রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই পড়ে লিখেছিলেন, ‘উড়িসনে রে পায়রা কবি/ খোপের ভিতর থাক ঢাকা।’ আর ‘শনিবারের চিঠি’ তো ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’-র প্যারডি করতেও ছাড়েনি। রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক যান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধী, এদিকে ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশেষ অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করলেন তিনি। অমনি সজনীকান্ত দাসের কটাক্ষ, ‘কবীন্দ্রেরে লুব্ধ করে করেছ একি দেশবাসী/ মাস্টারিতে দিয়েছ তারে চড়ায়ে/ হায় গো কবি, ঠাট্টা যারে করিতে আগে উল্লাসি/ গর্তে তারি আপনি এলে গড়ায়ে।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, নির্দোষ রসিকতা নয়, খোঁচা দেওয়ার মতো তামাশার মুখোমুখি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, বারে বারেই। একাল হোক কি সেকাল, আঘাত পাওয়ার নিয়তি তাঁকে তাড়া করেই ফিরছে। তবে রবীন্দ্রনাথ নিজে এসবকে কীভাবে গ্রহণ করতেন? আজকের বাঙালি যেমন তাঁর অসম্মানে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, আইনি লড়াইয়ের কথাও উঠছে, তিনিও কি তেমন পথেই এইসব আপত্তিকর তামাশার মোকাবিলা করতে চাইতেন?
রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, ব্যক্তিগত আঘাতকে তিনি সইতে জানতেন অনেকখানি। সত্যি বলতে, গোটা জীবন ধরে একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যুর শোক যিনি বুক পেতে নিয়েছেন, দেশ ও দশের দুঃখকে নিজের বলে ধারণ করেছেন, ছোট ছোট দুঃখকে তিনি কতটুকু গুরুত্ব দেবেন? তিনিই তো বলেছেন, ‘দুঃখ যখন আমাদের মারতে থাকে তখন তাকে অস্বীকার করতে পারি এমন শক্তি আমাদের আছে। বস্তুত সেইটেই মানুষের বীরত্ব।’ হ্যাঁ, এ সমস্ত বিদূষণের মধ্যে অহেতুক ঈর্ষা যেখানে প্রকাশ পেত, তা তাঁকে কষ্ট দিত বইকি। কিন্তু কখনও নিরুত্তর থেকে, কখনও হেসে উড়িয়ে দিয়েই তার মোকাবিলা করেছেন কবি। পশুপতি ভট্টাচার্যকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘যাই হোক আমাকে রাগী মেজাজের লোক বলে ভুল কোরো না– আমার সহজেই হাসবার ক্ষমতা আছে, সেই হাস্যরস অহিংস নীতির সহায়তা করে।’ যিনি তাঁকে অসম্মান করছেন তাঁর প্রতি যেন কোনও অবস্থাতেই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে না-ওঠেন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। বিশেষ করে অনুজ সাহিত্যিকদের বিরোধিতার মোকাবিলা করতে গিয়ে সে কথা মনে রেখেছেন তিনি। ১৯৩৮-এর ডিসেম্বর মাসে ভবানীপুরে ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’-র সর্বভারতীয় সম্মিলনে বুদ্ধদেব বসুর সূত্রে কথা ওঠে, ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়া সমাজের কবি রবীন্দ্রনাথের সময় গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ অভিমানী উচ্চারণে লিখলেন, ‘খবর এল, সময় আমার গেছে/ আমার গড়া পুতুল যারা বেচে/ বর্তমানে এমনতরো পসারী নেই’। মনে পড়বে ‘লিপিকা’-তেও ছিল এমনই এক পুতুলের কারিগরের গল্প, যার বানানো পুতুল একসময় আর হাটে বিকোয় না। মনে রাখা ভালো, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, এমন অনুজদের সঙ্গে আন্তরিক ঘনিষ্ঠতার পথে এইসব মান-অভিমান কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এমনকি ‘আনন্দ বিদায়’-এর লেখক, খোদ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথের।
-: আরও শুনুন :-
শিল্পীকে ক্ষতবিক্ষত করাই এ দেশের অভ্যাস! তারাশঙ্করকে কেন বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
তবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর ব্যক্তিগত ক্ষোভের একরকম প্রকাশ দেখা গিয়েছিল বটে। যে বাঙালি গোষ্ঠীর থেকে দীর্ঘ অসম্মান মিলেছে, সেই গোষ্ঠীর থেকে অভিনন্দন নিতে আপত্তি জানিয়েছিলেন কবি। তবে সে ঘটনা নিতান্তই ব্যতিক্রম। শোনা যায়, একান্ত সচিব কবি অমিয় চক্রবর্তীর লাঞ্ছনার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ নিজেই নাকি তাঁকে সজনীকান্তের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অথচ তাঁর নাম, লেখা, কাজ নিয়ে নানা আক্রমণেও তেমন কড়া উপায় অবলম্বন করেননি। বরং লেখার প্যারডি প্রসঙ্গে বলেছেন, “শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ করবার ক্ষমতার একটা অসামান্যতা অনুভব করেছি। বোঝা যায় যে এই ক্ষমতাটা আর্ট-এর পদবীতে গিয়ে পৌঁছেচে।” বোঝা যায় যে, কোনও তামাশা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যতই আঘাত করুক, সে আঘাতকে প্রায় সময়েই ব্যক্তিগত পরিসরেই বেঁধে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।