জীবনের পথে প্রতিকূলতা নিত্যসঙ্গী। কেবল তার রূপ বদলে যায়। সেই প্রতিবন্ধকতা কখনও শারীরিক, কখনও আবার মানসিক, কিংবা সামাজিক। চলতি প্যারালিম্পিক্সে ভারতীয় প্রতিযোগীদের ধারাবাহিক সাফল্য যেন শিখিয়ে দিচ্ছে, মনের জোরে কীভাবে জয় করা যায় প্রতিকূলতাকে।
চলতি প্যারালিম্পিক্সে ভারতের প্রথম পদক এসেছিল রবিবার। ভারতের প্রথম মহিলা প্যাডলার হিসেবে রুপো জয়ের নজির গড়েছিলেন ভবিনা হাসমুখভাই প্যাটেল। আর সোমবারই প্যারালিম্পিক্সের দুনিয়ায় নতুন ইতিহাস লিখল ভারত। অবনী লেখারার হাত ধরে টোকিও প্যারালিম্পিক্সে প্রথম স্বর্ণপদক পেল দেশ। সেই সঙ্গে ভারতের প্রথম মহিলা অ্যাথলিট হিসেবে প্যারালিম্পিক্সে সোনা জেতার নজিরও গড়ে ফেললেন উনিশ বছরের অবনী। একই দিনে প্যারালিম্পিক্সে সর্বকালের দীর্ঘতম থ্রো করে জ্যাভলিনে সোনা পেলেন সুমিত আন্তিল। এঁরা ছাড়াও নিশাদ কুমার, যোগেশ কাঠুনিয়া, দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া, সুন্দর সিং গুর্জর, সিংহরাজ আধানা, থাঙ্গাভেলু মায়াপ্পন, শরদ কুমার, একের পর এক নাম যোগ হয়ে চলেছে স্কোরবোর্ডে। বেড়ে চলেছে ভারতের পদকসংখ্যা। সে তুলনায় প্রচারের আলো কতটুকুই বা ঘিরে ধরেছে এঁদের! প্যারালিম্পিক্স বিষয়টা নিয়েই যে স্পষ্ট ধারণা নেই অনেকের।
আরও শুনুন: Refugee Olympic Team: দেশ নেই যাঁদের, অলিম্পিকের মঞ্চে তাঁরাই যেন আস্ত একটা ‘দেশ’
১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত কয়েকজন ব্রিটিশ সৈন্য জড় হয়েছিলেন এক জায়গায়। সেখান থেকেই আজকের প্যারালিম্পিক্সের সূত্রপাত। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষরাই অংশ নিতে পারেন প্যারালিম্পিক্সে। অলিম্পিকসের সমান্তরালে আয়োজন করা হয় বটে। তবে অলিম্পিকসের গ্ল্যামার, ফান্ডিং, প্রচারের ছিটেফোঁটা জোটে প্যারালিম্পিক্সের বরাতে। কিন্তু যে মানুষরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে খেলার মাঠে নেমেছেন, কোন প্রতিকূলতা আর দমিয়ে রাখবে তাঁদের? ভারতের এই পদকজয়ী অ্যাথলিটদের দিকেই দেখুন না!
আরও শুনুন: অলিম্পিকে হিটলারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক, এক ছবিতেই প্রাণ বেঁচেছিল এই অ্যাথলিটের
মাত্র ১ বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হন ভবিনা। শরীরের ৯০ শতাংশ অসাড়। টেবল টেনিস খেলেন হুইলচেয়ারে বসে। অথচ তাঁর হাত ধরেই চলতি প্যারালিম্পিক্সে প্রথম পদক পেয়েছে দেশ। একই দিনে রুপো পেয়েছেন ২১ বছরের নিশাদ কুমার। ১৪ বছর আগে ফসল কাটার যন্ত্রে হাত ঢুকে যায় তাঁর। ডান হাতের কবজির কিছুটা উপর অবধি বাদ দিতে হয়। তাই নিয়েই হাই-জাম্পে দেশকে জেতাচ্ছেন নিশাদ। ঠিক যেমন ৮ বছর বয়সে প্যারালাইটিক অ্যাটাক হওয়ার পরেও ডিসকাসে রুপো জিতছেন যোগেশ কাঠুনিয়া। ৮ বছর বয়সেই বাঁ হাত বাদ যায় দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়ারও। ইলেকট্রিক তারে হাত দেওয়ার ফল। ধাতব পাত পড়ে বাঁ হাত বাদ যায় সুন্দর সিং গুর্জরেরও। কিন্তু জ্যাভলিন থ্রোয়ে রুপো আর ব্রোঞ্জ এসেছে এই দুজনের হাত ধরেই।
গাড়ি দুর্ঘটনায় কোমরের নীচের অংশটা প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল ১১ বছরের অবনীর। টোকিওতে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল শ্যুটিং বিভাগে বিশ্বরেকর্ড গড়লেন ১৯ বছরের অবনী লেখারা। বিশ্বরেকর্ড গড়লেন সুমিতও। তাও একই দিনে তিন-তিনবার। অথচ আজকের জ্যাভলিন থ্রোয়ের চ্যাম্পিয়ন ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন কুস্তিগির। ২০১৫ সালে একটা আকস্মিক বাইক অ্যাক্সিডেন্টে বাদ পড়ে বাঁ পা। কুস্তিগির হওয়ার স্বপ্ন ভেঙেছিল বটে, কিন্তু পোডিয়ামের দৃঢ় মুখটাই বলে দিচ্ছিল, নিজে ভেঙে পড়তে রাজি নন সুমিত আন্তিল।
টোকিও প্যারালিম্পিক্স থেকে এখনও পর্যন্ত দশটি পদক সংগ্রহ করেছে ভারত। আর পদকের চেয়েও বেশি কিছু বোধহয় পেয়েছেন দর্শকেরা। আমাদের যাবতীয় শৌখিন না-পারা, না-পাওয়াকে সপাটে উড়িয়ে দিয়ে চলেছেন ভবিনা-অবনী-সুমিতরা। জীবনের প্রতিটি বাঁকেই হয়তো ভেঙে পড়ার মতো মুহূর্ত তৈরি হয়। কিন্তু সেইসব পরিস্থিতিকে হারিয়ে দেওয়ার জোর জোগায় এমন আলো। যত প্রতিকূলতাই আসুক, ইচ্ছার জোর যে মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে, জানায় সেই বার্তা।