বাঙালির পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের বাঙালি। ঠিক আগের মতোই আছে! নাকি পয়লা বৈশাখ নেহাত পোশাকি উদযাপনে এসে ঠেকেছে? তা নিয়েই নিজের ভাবনা জানালেন, পায়েল চট্টোপাধ্যায়।
পড়ে শোনালেন: চৈতালী বক্সী। গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক।
আমাদের পাড়ার বিলুকাকু মোটেই নিজের কোটরটি ছেড়ে নড়তেন না। শুধুমাত্র একটি দিন এলেই এক্কেবারে উল্টোটি ঘটতে দেখেছি। হালখাতার দিন। আমাদের বাড়ি থেকে তিনটে বাড়ি পরে বিলুকাকুদের বাড়ি। বিলুকাকুর বাবার একটা সাদা পাঞ্জাবি ছিল। সেটি পরে তিনি বিলুকাকুর মাকে নিয়ে প্রথমবার পয়লা বৈশাখের দিন হালখাতা করতে গিয়েছিলেন। কানাঘুষো শোনা যায়, এটা নাকি পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিলুকাকুর মা-ই, তাঁর বাবাকে উপহার দিয়েছিল। রোজগারহীন বউ সংসারের আলু, চাল, মাছ কম আনতে বলে বরের জন্যে উপহারের কথা ভাবে। এ কাউকে বলা যায় নাকি! এদিকে এই পাঞ্জাবিতে হালখাতার মিষ্টির রস পড়ে সে একেবারে রইরই কাণ্ড ঘটেছিল দোকানে। এক বছরও হয়নি তখন বিলুকাকুর মা-বাবার বিয়ে হয়েছে। লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বিলুকাকুর মা, বাবার পাঞ্জাবির পকেটে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়েছিল- ‘উপহার’। কাকুর বাবার সরু, হাড়জিরজিরে বুক চওড়া হয়ে গিয়েছিল। বিলুকাকু পাড়ার মাঠের উল্টোদিকের লাল রঙের রকটায় বসে কতবার যে এসব শুনিয়েছে!
সেই পাঞ্জাবি বিলুকাকু যত্ন করে রেখেছিল। যে বিলুকাকুর বাড়িতে মাসকাবারি বলতে চাল, আলু, মুসুরির ডাল আর কালেভদ্রে মাছ বা মাংস আসে, পনের দিন ছাড়া ছাড়া দেখতাম নীল রংয়ের বোতল আর সাদা ধবধবে প্যাকেট আসছে। আমরা পাড়ার কুঁচোগুলোও কম যাই না। একদিন পিছু নিলাম। কাকু একা মানুষ। শখ-আহ্লাদের সঙ্গে ভাব জমাতে দেখিনি। সেই বিলুকাকু এসব কী নিয়ে আসছে!
পাড়ার টেঁপিটা বদ। একদিন গুলতি দিয়ে সটান মারল পাতলা প্লাস্টিকের ব্যাগে। সাদা প্লাস্টিক ভেদ করে সে দীর্ণ করেছে আরেকটা প্লাস্টিক। ন্যাপথালিন পড়ে ছড়াছড়ি। বোতলের ছিপিটা খুলে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছে নীল রং। সাদা জামাকে সুন্দর, একই রকম সাদা রাখার যাবতীয় কৌশল টেঁপির আঘাতে কুপোকাত। আমরা রকের পিছন দিকে লুকিয়ে পড়েছি তখন। কাকু একটি শব্দও উচ্চারণ না করে ন্যাপথালিনগুলো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে তুলে নিল। বোতলটাও যত্ন করে তুলে নিল। এরপর সোজা নিজের বাড়ি। ক’দিন পর, ওই পয়লা বৈশাখের দু’দিন আগে রাস্তায় টেঁপিকে দেখে বলল, ‘হ্যাঁ রে, তোদের বাড়িতে ওই জামা-কাপড় কাচার সাবান আছে না কি রে?’ টেঁপির ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা না দেখেই সেদিন দৌড় দিয়েছিলাম।
এই বিলুকাকুর বিয়ে হল। কাকিমা মডেলিং করে। আমাদের বিলুকাকু বরাবর অন্যরকম। পয়লা বৈশাখ এলেই কাকুর সাজ দেখার অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। বাবার পাঞ্জাবি, বাঁ দিকে সিঁথি দেওয়া, অমলিন হাসি। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। নববর্ষ।
কাকুর যখন বিয়ে হল, আমাদের গরমের ঝিমিয়ে যাওয়া বিকেলগুলো টগবগ করে উঠল। কাকু কলকাতার একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করত। সেখানেই আলাপ কাকিমার সঙ্গে। কী করে প্রেম হল, আলাপ থেকে সংলাপ পর্ব হল, সেই নিয়ে সারা বিকেল আলোচনা চলত আমাদের। বদল দেখলাম আমরা। চেক শার্টের পকেটের গায়ে একটা ইয়াব্বড় সেলাই করা গোলাপ ফুল। চাল, আলু, মুসুরির ডাল আর পিঁয়াজকে ল্যাং মেরে কাকুর ব্যাগ ভরানোর দায়িত্ব নিয়েছে পাস্তা, মেয়োনিজ, মাল্টিগ্রেন ব্রেড। বাজারের ব্যাগ দেখে সমস্বরে চিৎকার করতাম- আপদ!
‘পড়োশোনা করগে যা’ বলে মুখ ভেঙিয়ে চলে যেত কাকু। মন খারাপ। এমন অজস্র মন খারাপের ঠিকানা হয়েছিল পাড়ার রকটা। যে বাড়ি থেকে পয়লা বৈশাখের সকালে মিষ্টি তৈরির সুগন্ধ হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ত, সেই বাড়িটায় দুপুরবেলা আর রান্না হয় না। কঠিন নাম রেস্তরাঁগুলোর। খেতে যায় সকলে। আমাদের দলটাও বিচ্ছিন্ন। তবু সন্ধেগুলো জোগাড় করে পাড়ার দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকি। হালখাতায় ভিড় হয় এখনও। একটা গন্ধ নেই কেবল। আমার ফুলছাপ জামাটা দিয়ে মা আজকাল মাইক্রোওভেন পরিষ্কার করে। বিলুকাকুকে আগের মতো করে পাড়ায় আর দেখা যায় না। বাজারের ব্যাগ বইতে হয় না। বাজার এনে দেয় মুঠোফোন।
গত বছরের ঠিক পয়লা বৈশাখের আগের দিনের কথা। কাকু সকালবেলা হাঁফাতে হাঁফাতে পাড়ার দোকানে এল, কী একটা কাপড় কাচার তরলের নাম বলল। আমি টেঁপির কানে কানে বললাম, ‘কাকু কী পাঞ্জাবি পরবে?’, টেঁপি এখন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বলল, ‘কাল একটু বেরোতে হবে, নইলে কাকুর সাজ মিস করতাম না।’
পাড়ার রকটা ভেঙে গেছে। আজ পয়লা বৈশাখ। সকলেই ব্যস্ত। আমি কেবল ভাঙা রকের ধারে দাঁড়িয়ে নখ খুঁটছি। বিকেলে টেঁপিকে আপডেট দেব। এ পাড়া এখন অ্যাপক্যাবের ম্যাপে ব্যস্ত পাড়া। গাড়ি ঢুকছে পাড়ায়। এ কী! সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা-কালো ধুতি পরে গাড়িতে উঠছে কাকিমা। কাকুর বাবার পাঞ্জাবিটা কাকিমা পরেছে! আজকাল মেয়েরা এসব পরছে জানি, আমাদের পাড়ায় এই প্রথম দেখলাম। নাহ! সব মিশে যাওয়া থেকে আটকানোর কোনও উপায় নেই। কাকুর দিকে চোখ ফেরালাম। বাড়ির দরজায় তালা লাগাচ্ছে। হাতে প্যাকেট। পরনে ফুলছাপ হাওয়াই শার্ট আর জিন্স। আমায় দেখতে পেয়ে একটা মোড়া কাগজ আমার হাতে দিল- “বাংলা ক্যালেন্ডার, আমাদের অফিসে একজন দিয়ে গেছে, আমার লাগবে না, মেসোমশাই তো এখনও লোকের বাড়ি পুজো-টুজো করেন, রেখে দে।” – আমার সামনে দিয়ে ‘বাংলা নববর্ষ’ তার সুগন্ধ ছাড়িয়ে বিলিতি পারফিউমের ছোঁয়ায় ‘বেঙ্গলি নিউ ইয়ার’ হয়ে গটগট করে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসল।
আমি তখন ভাঙা রকের ধারে বসে ক্যালেন্ডারের পাতায় পরের দিনের বাংলা তারিখ দেখছি। পরের পুজোর তিথি কী আছে বাবাকে দেখে বলতে হবে তো!