চোখের সামনে বোমায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বসতবাড়ি। হাতে হাতে ধরে প্রাণভয়ে বেরিয়ে পড়া দেশ ছেড়ে। ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি বাস্তুহারাদের সুযোগ করে দিয়েছিল ২০১৬ সালে। তৈরি হয়েছিল ‘রিফিউজি অলিম্পিক টিম’। এ বছর তারা সংখ্যায় প্রায় তিন গুণ। তাঁদের গল্পই শোনাচ্ছেন, চৈতালী বকশি।
বর্তমান পৃথিবীতে সন্ত্রাস, হিংসা আর যুদ্ধ প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন করে মানুষের থেকে তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে দিচ্ছে বাস্তুহারার তকমা। তাতেও দমে না, গিয়ে ইয়াসরা মারদিনি (Yusra Mardini), পোপলে মিশেনগা (Popole Misenga) , রোজ লোকোনিয়ান (Rose Nathike Lokonyen), অ্যাঞ্জেলিনা লোহালিথ (Anjelina Lohalith) -দের মত অ্যাথলিটরা সমস্ত প্রতিকূলতাকে হারিয়ে নিজেদের স্বপ্ন বুনে চলেছেন। এটা তাঁদের দ্বিতীয় বার, শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালে। তখন তারা ছিলেন ১০ জনের দল।
সাড়ে চার বছর পেরিয়ে, ২০২১-এ শুরু হওয়া টোকিও অলিম্পিকে, রেফিউজি অলিম্পিক টিমের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বিগত বছরগুলিতে এই হারেই কি বেড়েছে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যাও? নাকি, এই সংখ্যায় তিনগুন হয়ে ফিরে আসা, হার-না-মানা উদ্বাস্তু মনোভাবেরই প্রতীক! যেন তারা বলতে চায়, – ভোলনি তো আমাদের? উদ্বাস্তুরাও, আর পাঁচজনের মতো সাধারণ মানুষ। তাদেরও কিছু বিশেষ ক্ষমতা আবার কিছু .দুর্বলতা আছে। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তারাও অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন দেখে। যুদ্ধের অস্থিরতাকে হারিয়ে শান্তি আকদিন আসবেই, তাদের সেই আশার প্রতীক-ই যেন টোকিও অলিম্পিক। সব হারিয়েও তাই, সিলেক্ট হওয়ার আনন্দ, চোখে জল এনে দেয় তাদের।
আরও শুনুন: Olympics: ফুটবলে এশিয়ার প্রথম হ্যাটট্রিকের রেকর্ড ভারতেরই
রাষ্ট্রসংঘের নিয়মে উদ্বাস্তু স্বীকৃতি পাওয়া ৫৬ জন অ্যাথলিটের মধ্যে, এবার ২৯ জন টোকিও অলিম্পিকে পারফর্মেন্সের সুযোগ পেয়েছেন, সমস্ত নিয়মের মাপকাঠিতে পাশ করে।
১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিক শুরু হওয়ার পর, সব অ্যাথলিটরা জোর কদমে অনুশীলন চালাত নিজের নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে বলে। কিন্তু উদ্বাস্তুরা বাদ পড়ে। মধ্য-প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, মূলত সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, আফ্ৰিকার ইরিট্রিয়া, আফগানিস্তান, এবং ইরান থেকে হাজার হাজার বাস্তুহারা মানুষ, যখন ইউরোপ বা অন্যান্য দেশে আশ্রয় বা খাবারের খোঁজে পালিয়ে আসতে লাগল, তখন বিষয়টি নজরে আনার জন্য আইওসি (The International Olympic Committee) – সিদ্ধান্ত নেয় এই রেফিউজিদের নিয়ে একটি টিম তৈরির। যারা অলিম্পিকে রেফিউজিদের প্ৰতিনিধিত্ব করবে। সন্ত্রাস, যুদ্ধ, বিপর্যয়কে সামলে করবে অপ্রতিরোধ্য লড়াই। বিশ্বের সকল উদ্বাস্তু মানুষের মনে আশা ও আত্মবিশ্বাসের মশাল জ্বালিয়ে রাখতে, ২০১৬ অলিম্পিকের মঞ্চে দেখা যায় ‘রেফিউজি অলিম্পিক টিম’-কে । টিমের ১০ সদস্যকে, ক্রাইস্ট ডি রিডিমার তার শহরে, সাদর অভ্যর্থনা জানান। জাপান অলিম্পিকে যোগ দেওয়ার আগে কাতারে তাদের অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়। কাতার অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট শেখ জোয়ান বিন হামাদ আল থানি বলেছেন, “এই দলের অলিম্পিকে পারফরম্যান্স শুধু কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিতই করবে না, বিশ্বজুড়ে উদ্বাস্তুদের সঙ্কটের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিরও কাজ করবে।
আরও শুনুন: Mohun Bagan Day: আমিরের ‘লগান’-কে হার মানায় ২৯ জুলাইয়ের সত্যি রূপকথা
গোটা বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যাটা বেশ উদ্বগজনক। হ্যাঁ, বিশ্বের মোট ৮ কোটি ২৫ লক্ষ উদবাস্তু মানুষের প্রতিনিধি যেন এই ২৯জন। ওপেনিং সেরেমনিতে, অলিম্পিক গেমসের ফ্ল্যাগকে সামনে রেখে, প্রতিষ্ঠাতা দেশ গ্রিসের পরেই দ্বিতীয় ভাগ্যশালী দেশ হিসেবে হাঁটে দেশ-হারা এই ২৯ জনের দল। গোটা বিশ্বের সামনে এরা তুলে ধরেন শান্তি ও সংহতির বার্তা। নিজেদের খেলার মাধ্যমে তাঁরা জীবনের জয়গাথাই যেন গাইছেন এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে। আর অলিম্পিকের জ্বলতে থাকা মশালের মতই উদ্বাস্তুদের আশা ও আত্মবিশ্বাস আর স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিচ্ছে টোকিও অলিম্পিক।