বিজয়া দশমীতে ঘরের মেয়ের বিদায়। আবার এক বছরের অপেক্ষা। তবুও বিসর্জনের শেষে মিষ্টিমুখ, আলিঙ্গন ও শুভেচ্ছা জানানোর পালা চলে। বিদায়ের দুঃখের আবহেই কেন এহেন আনন্দ রীতিও জারি থাকে? জানালেন সৌভিক রায়।
নবমীর রাতে ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়েছে কি পেরোয়নি, হোয়াটস্অ্যাপে বন্যা বয়ে গেল শুভ বিজয়ার মেসেজের। টাইমলাইনে টাইমলাইনে মিষ্টির হাঁড়ির ছবি। কেউ কেউ ফরমান দিয়ে দেন, ঠাকুর জলে না পড়া অবধি যেন শুভ বিজয়া না জানানো হয়। সে যাই হোক, কখনও ভেবে দেখেছেন, মেয়ে বিদায়ের তিথিতে কেন কোলাকুলি, মিষ্টিমুখে মেতে ওঠেন বঙ্গসন্তানেরা?
ভারতের অন্যান্য অনেক প্রদেশ দশমীকে দশেরা হিসাবে পালন করে। পৌরাণিক আখ্যান বলে, ন-দিনের যুদ্ধের পর শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে দেবী বিজয়ী হয়েছিলেন, তাই তিথিটি বিজয়া দশমী। রামায়ণ বলে, রাম-রাবণের যুদ্ধও শেষ হয়েছিল এই দিনে। তবে বঙ্গে বিজয়া দশমী ঠিক কেমন?
বাড়ির মেয়ে বাপের বাড়ি ছেড়ে কৈলাসে ফিরবেন। মেয়ের বিদায় দুঃখের তো বটেই। অপরাজিতা পুজো সেরে, নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে মাকে বিদায় জানানো হত এককালে। মহাসমারোহে বিসর্জনের শোভাযাত্রা চলত। আজও চলে। কোথাও কোথাও তোপ দেগে, বন্দুক চালিয়ে মাকে বিদায় জানানো হত। বিসর্জনের পর চলে বিজয়ার পালা, অর্থাৎ মিষ্টিমুখ, কোলাকুলি, প্রণাম, স্নেহ-আশীর্বাদ বিনিময়। এ ছাড়াও অনেক রীতি রয়েছে, যেমন, দশমীর দিন কোনও কোনও বাড়িতে জোড়া ইলিশ আনা হয়, যাত্রাঘট পাতা হয়, আবার লক্ষ্মীপুজোর কদম ফুল কিনে ফেলা হয়। নিয়ম রীতির অন্ত নেই বাঙালির। কিন্তু উমার বিদায় তো সত্যিই দুঃখের, তবে কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখের অবতারণা কেন? দুঃখ ভুলতেই এমনটা করা? নাকি অন্য কারণ রয়েছে?
উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হয় বেদের কালে। ঋগবেদের সময়ে এক শরৎ থেকে আরেক শরতে বছর গণনা করা হত। শরৎ ঋতুতেই বছর আরম্ভ হত। তখন দীর্ঘায়ু কামনায় বলা হত, ‘জীবেম শরদ শতম’। যা আদপে একধরনের শতায়ু কামনা। বিজয়া দশমী ছিল শরৎ বর্ষের প্রথম দিন, অর্থাৎ বিজয়া দশমীই হল নববর্ষের উৎসবের দিন। আত্মীয়-পরিজন নিয়ে আনন্দ-আহ্লাদে, খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে দিনটি অতিবাহিত করার নিয়ম ছিল। মনে করা হত, বছরের প্রথমদিন ভালো কাটালে সারাবছর ভালো যাবে। বিজয়া নামের উৎপত্তির একটি সংগত কারণ এখানে খুঁজে পাওয়া যায়; এই দিনটিতে প্রার্থনা করা হত ‘নববর্ষে সকলের বিজয় হউক’।
স্পষ্টভাবে বললে, বৈশাখের নববর্ষ বা পুণ্যাহ হল ব্যবসায়ীদের। এককালে জমিদার, ভূস্বামীদের খাজনা আদায়ের জন্যেই তার প্রচলন ঘটেছিল। অগ্রহায়ণে নবান্ন হল কৃষকদের নববর্ষ। বর্ধমানের কিছু অঞ্চলের কৃষকেরা আবার আষাঢ়ে নববর্ষ ও হালখাতা পালন করেন আজও। আম বাঙালির নববর্ষ ছিল বিজয়া দশমী। যা আনন্দের উৎসব, বর্ষের শুভারম্ভ। কালে কালে সেই নববর্ষ হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রয়ে গিয়েছে সামাজিক আচারগুলি। উমার বিসর্জনের পর প্রণাম, আশীর্বাদ, কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ অদ্যাবধি সেই স্মৃতিই বহন করছে।