দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তার দায়ভার নিহিত রয়েছে মূলত জেন-জির হাতেই। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক জেন-জি-দের মধ্যে প্রায় ৯১%-ই জানাচ্ছেন যে তাঁরা প্রত্যেকেই কখনও না কখনও এমন ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন, যা পরবর্তীকালে নানারকম শারীরিক অসুস্থতার দিকে গড়িয়েছে। আগের প্রতিটি প্রজন্মের চাইতে বেশি সুযোগসুবিধার অধিকারী হয়েও কেন সারাক্ষণ একাকীত্বে ভুগে চলেছে তারা?
তাদের মুঠোর মধ্যে বন্দি গোটা দুনিয়া, তারা চাইলেই বন্ধুত্ব করে ফেলতে পারে পৃথিবীর একেবারে অপর প্রান্তে থাকা মানুষটির সঙ্গে। এমনকি প্রযুক্তিগত যেকোনো খুঁটিনাটি তাদের একেবারে হাতের মুঠোয়। তবু কেন ‘সব পেয়েছির দেশ’-এর বাসিন্দা ‘জেন-জি’রা বেশিরভাগ সময় মনকেমনে ভুগছে? আগের প্রতিটি প্রজন্মের চাইতে বেশি সুযোগসুবিধার অধিকারী হয়েও কেন সারাক্ষণ একাকীত্বে ভুগে চলেছে তারা?
জেন-জি বা জেনারেশন জেড, অর্থাৎ সেই সমস্ত ছেলেমেয়ে, যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২-এর মধ্যেকার সময়ে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যদি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলি আমরা, তাহলে সবার প্রথমে বলতে হয় যে তা নির্ধারিত হবে আগামী ৩০ বছর সময়কালে। আর সে ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তার দায়ভার নিহিত রয়েছে মূলত জেন-জির হাতেই। তারা আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তার উপরেই নির্ভর করবে যে আগামীদিনের ভারতবর্ষের স্বরূপ কেমন হবে।
কিন্তু এতে বাধ সাধছে জেন-জি-দের নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিই। একদিকে দেখা যায় যে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের চারিপাশের ঘটনাবলী সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল থাকে। নির্ভয় হয়ে তাদের মত প্রকাশ করে। আগের প্রজন্মের মতো দ্বিধাপূর্ণ, সাবধান পদক্ষেপ গ্রহনে বিশেষ একটা বিশ্বাস রাখে না তারা। অথচ সমীক্ষা বলছে, সবচাইতে বেশি মানসিক কষ্টেও নাকি এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই ভুগছে। এমনকি জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে আত্মহনন বেছে নেওয়ার প্রবণতাও সবথেকে বেশি এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। এমনটা কেন?
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ‘ভালো আছো’ কিনা জানতে চাইলে, ‘হ্যাঁ’ বলছে কেবলমাত্র ৪৫% জেন-জি ছেলেমেয়ে, যা এযাবৎকালের মধ্যে সবচাইতে কম। প্রাপ্তবয়স্ক জেন-জি-দের মধ্যে প্রায় ৯১%-ই জানাচ্ছেন যে তাঁরা প্রত্যেকেই কখনও না কখনও এমন ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন, যা পরবর্তীকালে নানারকম শারীরিক অসুস্থতার দিকে গড়িয়েছে। এর অন্যতম কারণ হল, সোশ্যাল মিডিয়া। আজ্ঞে হ্যাঁ, জেন-জি জানাচ্ছে, প্রতিদিন প্রায় দশ মিনিটের ব্যবধানে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট-টি চেক করবার অভ্যাস রয়েছে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশের। সপ্তাহে কমপক্ষে দুই-তিনদিন তারা ফটো পোস্ট করে বা স্টেটাস আপডেট করে বাকিদের জানান দিচ্ছে যে, তার জীবনে এই মুহূর্তে ঠিক কী চলছে। যিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, যাঁর কাছে অঢেল পোশাকআশাক-গয়নাগাঁটি রয়েছে কিংবা বছরে একাধিকবার বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা-ই জানাচ্ছেন বাকিদের। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন, এই ধারা অব্যহত রাখতে। সে জন্য হয়তো অনেক সময়েই নিজের সাধ্যের বাইরে বেরিয়েও জিনিসপত্র কিনে ফেলছেন তাঁরা। উদ্দেশ্য একটাই, ‘ফলোয়ার’-দের চোখে নিজেকে মূল্যবান প্রমাণ করা। অন্যদিকে, তাঁর পোস্ট-টি দেখে আবার উল্টোদিকে থাকা ছেলে বা মেয়েটি হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করছে, ক্রমাগত অনুভব করছে যে সে একাই বুঝি পিছিয়ে পড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় এই অস্বাভাবিকতার নাম ‘ফোমো’, অর্থাৎ ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’।
জেন-জি-র কাছে ব্যস্ত হওয়ার মতো এতরকম প্রলোভন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারিপাশে যে সে বারবার ভুলতে বসছে বাস্তব জগতটার কথা। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার বদলে, বাড়ির আরামে বসে কেবল একটা মেসেজ পাঠিয়েই কাজ সেরে দিচ্ছে সে। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে বর্তমানে মনুষ্যচালিত বহু জবরোল-ই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। যা কিছু আমাদের জীবনকে সহজ করে, তাই যে আমাদের সঙ্গীহীন করে তোলে, তাই যেন ভুলতে বসেছি আমরা।
এই ছদ্ম ভালো থাকার অভিনয়ই বুঝি এই প্রজন্মের মানুষদের আরও বেশি করে ঠেলে দিচ্ছে ডিপ্রেশনের দিকে। মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার মতন বন্ধু পাচ্ছেন না। অনেকেই আবার মনের কথা বলবার জন্যই বেছে নিচ্ছেন কোনও এআই চ্যাটবট-কে! কিছুদিন আগেই যেমন লাস ভেগাস-এর এক ব্যক্তি একাকীত্ব কাটাতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন তাঁর নিজের ফোনটির সঙ্গে; তাঁর বক্তব্য, ফোনটির সঙ্গেই বিগত বছরগুলিতে সবথেকে বেশি সময় কাটিয়েছেন তিনি। শুনতে হাস্যকর হলেও, এ যেন এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের সূচনার ক্ষণ। যত সহজে গোটা বিশ্বের তথ্য ঘরে বসেই হাতে পেয়ে যাচ্ছে মানুষ, ততই যেন সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। যত বেশি বিশ্বস্তরে যুক্ত হতে চাইছে সে, তত বাস্তব জীবনের পরিসরে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। আর ছদ্ম সামাজিকতার এই কফিনে প্রথম পেরেকটি পোঁতাই হচ্ছে জেন-জি-র হাত ধরে!