কথায় কথায় আমরা বলে থাকি ভোটযুদ্ধ। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ নিশ্চয়ই থাকে। তবে, ভোট কি সত্যিই যুদ্ধ? ভোট মিটে যখন নতুন সরকার কাজ শুরু করেছে, ঠিক তখনই এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। কী তাঁর অভিমত? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছিলেন যে, আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে বিজেপি একা চলতে গিয়েই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। আপাতত জোটসঙ্গীদের পাশে নিয়েই নতুন সরকার গড়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আর ঠিক সেই সময়েই ভোট-সংস্কৃতি নিয়ে নিজের মতামত জানালেন সংঘপ্রধান মোহন ভাগবত। তাঁর মতে, ভোট কখনও যুদ্ধ হতে পারে না। আর সেই যুদ্ধং দেহি মনোভাবের জন্য যে সমাজে বিভেদও বেড়েছে, তা-ও স্বীকার করে নিলেন তিনি।
একেবারে চাঁচাছোলা ভাষাতেই ভোট-সংস্কৃতির সমালোচনা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, নির্বাচন গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু তা যুদ্ধ নয়। বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীর মতোই একজন চাইবেন, প্রতিপক্ষের থেকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার একটা মর্যাদা থাকা উচিত। মানুষ একজনকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন, তিনি সংসদে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করেন। এই-ই তো স্বাভাবিক নিয়ম। তার ভিতর মিথ্যের বেসাতি থাকবে কেন? ভোট চলাকালীন, যেভাবে একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছেন, যে ভাবে এবং যে ভাষায় তা করা হয়েছে, তার সঙ্গে একেবারেই সহমত নন তিনি। এবং দরুন সমাজে যে বিভাজনের জন্ম নিয়েছে, তাও স্বীকার করে নিয়েছেন ভাগবত। ভোটে জিততে যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে, সেখানে দেশের উন্নতি কীভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। পাশাপাশি এই সবকিছুর ভিতর আরএসএস-এর মতো সংগঠনকে যেভাবে টেনে আনা হয়েছে, তাতে ব্যথিত তিনি।
আরও শুনুন: ডিউটিতে চড় মেরে বিতর্কে! নিজের পেশা আর উর্দির জন্য তবু গর্বিত কুলবিন্দর
তাঁর এই মতামতে যথারীতি শোরগোল পড়েছে রাজনৈতিক মহলে। অনেকের ধারনা, ভোটের আগে বিজেপি-আরএসএস সম্পর্কে অসন্তোষের যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, তার প্রেক্ষিতেই ভাগবতের এই মন্তব্য। শোনা গিয়েছিল, কেবল মোদির গ্যারান্টি ধরে প্রচার না করে, সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিল সংঘ। অনেকাংশেই তা অবহেলা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, কার্যত বিজেপির গড় হিসাবে পরিচিত রাজ্যেই তাদের জোর ধাক্কা খেতে হয়েছে। তাহলে কি ভাগবতের এই মন্তব্য বিজেপি এবং নতুন সরকারের প্রতিই বার্তা? রাজনৈতিক মহলে উঠছে সেই প্রশ্ন। তিনি অবশ্য কোনও দলের নাম উল্লেখ করে কিছু বলেননি। বরং তাঁর বক্তব্যের অনেকটাই ছিল, ভোট নিয়ে দেশে যে যুদ্ধ-সংস্কৃতির আমদানি হয়েছে, তারই সমালোচনা। শুধুমাত্র ভোটে জেতার জন্য মিথ্যের আশ্রয় নেওয়া বা সামাজিক বিভাজনকে প্রশ্রয় দেওয়া যে একেবারেই অনুচিত, সে বিষয়ে জোর সওয়ালই করেছেন সংঘপ্রধান। বারংবার তিনি নির্বাচনে মর্যাদা কথাটিকে গুরুত্ব দিয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকতেই পারে। তবে তা হতে হবে সম্মানজনক উপায়ে। এবং গণতন্ত্রে বিরোধীর কথাও যে সামনে আসতে হবে, তাদের একেবারে বিসর্জন দেওয়া চলে না, সে কথাও খুব খোলাখুলি বলেছেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর ইঙ্গিত, একটা সরকার চলছে মানেই তা যে চ্যালেঞ্জহীন তা ভেবে নেওয়া উচিত নয়। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে আত্মতুষ্টির জন্ম দেয়, সরাসরি তার বিপক্ষে মত দিয়েছেন তিনি।
বিজেপিকে নিশানা হোক বা অন্য দলকে, ভাগবতের এই বক্তব্য ভারতবর্ষের ভোটের হাওয়া বদলানোর জন্য অত্যন্ত জরুরি। ভোটে জেতা জরুরি। তবে, তার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করা কি আদৌ জরুরি? মিথ্যে বা বিভাজনকে ইন্ধন দেওয়া কি জরুরি? প্রশ্নগুলি বারবারই উঠেছে। আবার মিলিয়েও গিয়েছে। তবে, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি না হলে কিন্তু দেশের ভোটের সংস্কৃতি সত্যিই বদলাবে না। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কিছুদিন আগে এই প্রসঙ্গ টেনেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ভোট এলে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশেরই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। রাজনৈতিক এই বাধ্যবাধকতা না-পসন্দ ছিল তাঁর। সংঘপ্রধানও তাঁর বক্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ভোট এখন যেভাবে যুদ্ধের মতো করে লড়া হচ্ছে, তার সঙ্গে একমত নন তিনি। তাহলে কি আগামী দিনে ভোটে বদলের হাওয়া বইবে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, তা কি চলতি নির্বাচন কাঠামোতেই সম্ভব নাকি সেখানেও বদল আসবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর অবশ্য এখনই স্পষ্ট নয়। তবে ভোটে জেতার জন্য যা-কিছু-করা থেকে যে বেরনোর ভাবনা যে ক্রমশ দানা বাঁধছে, সে ইঙ্গিত ক্রমশ মিলছে।