‘থ্রি ইডিয়ট’-এর ফুংশুক ওয়াংড়ু’কে মনে আছে নিশ্চয়। অনেকেই জানেন, তিনি লাদাখের বিজ্ঞানী সোনম ওয়াচুংক। তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন কলকাতার বাসিন্দা সত্যেন দাশ। কলকাতার এক বাসিন্দা লাদাখে গিয়ে এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করেছেন এ আর এমন কি খবর! কিন্তু খবর আসলে সত্যেন লাদাখ গিয়েছিলেন নিজের রিকশা করে। দেশে লাগাতার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রিকশাচালক সত্যেন দাস এবার রিকশা নিয়ে যাচ্ছেন সিয়াচেন। শুনে রোমাঞ্চিত হচ্ছেন নিশ্চয়!
মাথায় ভূত চেপেছিল নয়ের দশকের শুরুতে। সেবার এলাকার লোকজন পিকনিকে যাওয়ার কথা পুরীতে। মাথাপিছু খরচ প্রায় চারশ টাকা। সেই টাকাতেই যাওয়া থাকা খাওয়া সবই। সত্যেনের হাতে অতো টাকা নেই, কিন্তু তাঁর যাওয়ার ইচ্ছে ষোল আনা। তিনি ট্যুর কন্ডাক্টরদের বললেন, এখন দুশো নাও, ফিরে এসে বাকী দুশো দেব। কেউই তাতে তাঁরা রাজী নয়। তারপর তিনি বন্ধুদের প্রস্তাব দিলেন, যদি আমি অন্যভাবে যাই তাহলে কি খুব অসুবিধে হবে? কীভাবে? সেবার ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন পুরীতে। সত্যেন দাসের যাত্রার সেই শুরু। সাইকেলে ধীরে ধীরে ঘুরে এসেছেন ভারতের নানা জায়গায়।
রিকশায় স্ত্রী কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরিয়ে এনেছেন কাশ্মীর তথা বৈষ্ণোদেবীতেও মন্দির। ইচ্ছে চাপে লাদাখ যাওয়ার। চারচাকার গাড়ি, বাইক, বা হেলিকপ্টারে লাদাখ যাওয়া এখন প্রায় জলভাত। অপরূপ সৌন্দর্য এবং দুর্গমতা দুই মিলে লাদাখকে আলাদা করেছে বাকী অন্য পাহাড়ি অঞ্চলের থেকে। সত্যেন ঠিক করলেন, লাদাখ যাবেন, কিন্তু যাবেন, সেই সাধের রিক্সায়। যেখানে বাইকে গেলেও রীতিমতো উচ্চতার কারণে শ্বাসের সমস্যা হয়, সেখানে রিকশায়! শুনে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন। অনেকেই ভাবলেন নেহাত ‘আকাশকুসুম’। কিন্তু সত্যেন নাছোড়। মাঝে পড়ে জোজিলা পাস। তাকে বলা হয় ডেড জোন। সেখানে যেমন অক্সিজেনের সমস্যা, তেমনই যোগাযোগের। আর গেলেও রিক্সায় তো থাকা সম্ভব নয়। যাত্রার খরচও বিপুল। এহেন পরিস্থিতিতে কি করবেন! এই ছিল চিন্তা কিন্তু এই সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে সত্যেনের ত্রিচক্র যান এগিয়েছেন অভীষ্ট গন্তব্যের দিকে।
আরও শুনুন: আজও নাকি দুর্ঘটনার হাত থেকে মানুষকে বাঁচান রহস্যময় ‘Bullet বাবা’
১১ই জুন ২০১৪, এইদিন রিকশায় প্রথমবার লাদাখ পাড়ি দিয়েছিলেন সত্যেন দাস। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রাস্তা। উচ্চতায় প্রায় পাঁচ হাজার মিটার। সেই ভূখণ্ড ছুয়ে এসেছিলেন সত্যেন। ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী’র পরিচালনায়, ফিল্মস ডিভিশন-এর প্রযোজনায়, সত্যেনকে নিয়ে নির্মিত হয়েছিল তথ্যচিত্র ‘লাদাখ চলে রিকশাওয়ালা’। সেই ছবি ২০১৮ সালে জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে ‘এক্সপ্লোরেশন/ অ্যাডভেঞ্চার’ ফিল্ম হিসাবে সেরা-র শিরোপা পেয়েছিল।
দু হাজার একুশের আগস্ট মাসের পয়লাতেই সত্যেন আবার রওনা হয়েছেন সিয়াচেনের উদ্দেশ্যে। তবে এইবারের যাওয়ার উদ্দেশ্য স্রেফ অ্যাডভেঞ্চার বা নিছক ভ্রমণ নয়। এবার রয়েছে বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য। তিনি সমগ্র যাত্রাপথে প্রচার করবেন, প্যাডেল গাড়ির, সাইকেল বা রিকশার। এমনিতেই করোনা কাঁটা এবং লকডাউনের জোড়া ফলায় ক্ষত-বিক্ষত মানুষ। যানবাহনের অপ্রতুলতায় কলকাতা থেকে শহরতলি সব-জায়গায় ফিরেছে সাইকেলের ঘণ্টি। সাইকেলে সওয়ার হয়ে মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন গন্তব্যে। কিন্তু কলকাতা শহরের কথাই ধরুন, শহরের ব্যস্ত রাস্তায় নেই কোনও সাইকেল লেন। করোনার কারণে আপাতত পুলিশ খানিক ছাড় দিলেও, এইসব রাস্তায় সাইকেলের দেখা মিললেই জরিমানা ছিল অবধারিত। এদিকে বাসে, ট্রেনে গাদাগাদি অবস্থা। যাত্রী বেশি, পরিষেবা কম। বাইক বা স্কুটার চড়বেন, সে নিয়েও সেগুড়ে বালি। কারণ পেট্রোলের দাম ইতিমধ্যেই সেঞ্চুরি পার করেছে। অতয়েব ভরসা সেই সাইকেল। সস্তা, সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব। দেশের নানা শহরের রাস্তায় পৃথক সাইকেল লেনের দাবীতে তিনি পাড়ি দিচ্ছেন, পৃথিবীর অন্যতম উচ্চতর যুদ্ধক্ষেত্রে। এবারের তাঁর গন্তব্যের দূরত্ব সাত হাজার কিলোমিটার। পৌঁছতে লাগবে অন্তত তিন মাস। যাওয়ার সময় তিনি যাবেন মানালি হয়ে। ফেরার সময়ে তিনি ফিরবেন শ্রীনগর হয়ে।
আরও শুনুন: e-RUPI’র মাধ্যমে আরও সহজ হবে লেনদেন, জানুন কীভাবে ব্যবহার করবেন এই পরিষেবা
২০১৪-তে লাদাখ যাত্রার সময়ে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে প্রচার করা। সেবার রাস্তায় তিনি বিলি করেছিলেন অন্তত পাঁচ হাজার গাছের চারা। এবারের যাত্রায় তাঁর মূলমন্ত্র, জল বাঁচান, পরিবেশ বাঁচান, পৃথিবী বাঁচান। সে কারণেই তিনি এবারেও বিলি করবেন গাছের চারা। করোনা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে যে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সে বিষয়ে তিনি সচেতন করবেন মানুষকে। সেই সঙ্গে উৎসাহ দেবেন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, এবং মাস্ক পরার জন্য। তাই তিনি বিলি করবেন অন্তত এক হাজার মাস্ক।
এতকিছুর পরও কিন্তু নির্বিকার সত্যেন। ইতিমধ্যেই ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড’ এবং ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ড’-এর জন্য মনোনীত হয়েছে তাঁর নাম। কিন্তু লাদাখ হোক বা সিয়াচেন, কাশ্মীর হোক বা কন্যাকুমারী রিকশা নিয়ে ফিরে এলে। সত্যেন দাশকে আপনারা খুঁজে পাবেন, নাকতলা মেট্রো স্টেশনের বাইরের রিকশা স্ট্যান্ডে। একবার জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গী ও সওয়ারি হয়ে দিব্যি কেটে যাবে আপনার যাত্রাপথ।