বাপি লাহিড়ি মানেই সুরের উচ্ছ্বাস। গানে গানে প্রাণোচ্ছ্বল জীবনের সেলিব্রেশন। সুরের চলনে যেমন বাঁধভাঙা জীবনকে উদযাপন করেছেন, ব্যক্তিজীবনেও মানুষটা ছিলেন তেমনই রঙিন। শ্রোতা তাঁর গান শুনলে চোখ বুঝেই বলে দিতে পারে, এই সুর বাপি লাহিড়ির রচনা। এতটাই ইউনিক ছিল তাঁর সুর। ঠিক সেরকমই ইউনিক তাঁর স্টাইল। বাপি লাহিড়ি মানেই গলায় হরেক রকমের বাহারি সোনার হার। এরকম ইউনিক স্টাইল কেন নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তিনি? কেনই বা এত ভালবাসতেন সোনার হার? আসুন সেই গল্প শুনে নেওয়া যাক।
গলায় লম্বা সোনার হার। একখানা নয়, একাধিক। চোখে রঙিন চশমা। লম্বা চুল। মুখে হাসি। বাপি লাহিড়ী মানেই একেবারে ইউনিক স্টাইল। হিন্দি ছায়াছবির গানে যেমন নিজের ঘরানা তৈরি করেছিনে, সুরের সেই সিগনেচারের মতো নিজের স্টাইলেও এনেছিলেন স্বাতন্ত্র। এলভিস প্রেসলি বললেই যেমন চোখের সামনে ভাসে সোনার ক্রস, কিংবা মাইকেল জ্যাকসন বলতেই ফুটে ওঠে বাহারি সানগ্লাসের ছবি- তেমনই বাপি লাহিড়ি মানেই সোনার হারের বাহার।
আরও শুনুন – থামল সুরের সফর, প্রয়াত গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
তাঁর এই সোনার হার পরা নিয়ে কম রসিকতা হয়নি। দিওয়ালির দিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়িয়েছে বাপি লাহিড়ির ছবি। একবার তো অভিনেতা রাজকুমার মজা করে বলেছিলেন, বাপি লাহিড়ি এত এত গয়না পরেন, যে, খালি মঙ্গলসূত্র পরাটাই যা বাকি! এইসব সব কথা তিনি যে জানতেন না, তা নয়! বিলকুল জানতেন। একবার বলেওছিলেন সে কথা। বলেছিলেন, এ নিয়ে যে অনেকেই যে মজা-ঠাট্টা করে সে জানতে আর তাঁর বাকি নেই। কিন্তু তা বলে এই সোনার চেন খুলে রাখতে তিনি রাজি নন। কেননা, এগুলোই তাঁর পরিচয়, ঠিক যেমন তাঁর সুরই তাঁর পরিচয়।
আরও শুনুন – পরিচালক ভাবেননি তাঁর কথা, নিজেই আনারকলি হতে চেয়েছিলেন মধুবালা
কেন সোনার হারকেই নিজের সিগনেচার করে তুলেছিলেন বাপি লাহিড়ী? এর উত্তর পেতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে তাঁর কেরিয়ারের একেবারে গোড়ার দিকে। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘জখমি’। সেই সিনেমার জন্য গান তৈরি করেছিলেন বাপি লাহিড়ি। গানের রেকর্ডিং যখন হচ্ছে তখন তাঁর মা তাকে একখানা সোনার হার দিয়েছিলেন। লকেটে লেখা ভগবানের নাম। সেই শুরু। তারপর থেকে কেরিয়ার যত এগিয়েছে, বাপি লাহিড়ির হারের দৈর্ঘ্যও বেড়েছে, সংখ্যাও বেড়েছে। আসলে এই সোনার হারকেই তিনি তাঁর লাকি চার্ম বা সৌভাগ্যের প্রতীক বলে বিশ্বাস করতেন। বিয়ের পর তাঁর স্ত্রী-ও তাঁকে বলেছিলেন একই কথা। সোনা হচ্ছে সৌভাগ্যের চিহ্ন। তা যেন তিনি সর্বদা সঙ্গে রাখেন। সেই কথা কখনও ভোলেননি বাপি লাহিড়ি। যে যতই মজা করুক না কেন, সোনার চেন ছাড়া বাপি লাহিড়ির পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স ভাবাই যেত না। তিনি কোনোদিন সেরকম কোনও ভাবনাকে প্রশ্রয়ও দেননি। সোনার একটি গণপতি মূর্তি হারের সঙ্গেই তাঁর সঙ্গে থাকত সর্বক্ষণ। শিল্পীর বিশ্বাস ছিল, গণপতি তাঁর সঙ্গে থাকা মানে তিনি নিরাপদ। এই বিশ্বাসকেই তিনি তাঁর সিগনেচার করে তুলেছিলেন। আমাদের দেশে খুব কম শিল্পীই এরকম আছেন, যিনি নিজের কাজের পাশাপাশি নিজের স্টাইল স্টেটমেন্টও এরকম ভাবে রচনা করেছেন। বাপি লাহিড়ী এখানেও ব্যতিক্রমী।
আরও শুনুন – পুনর্জন্মে এই দেশের মাটিতেই আবার ফিরতে চেয়েছিলেন সুরের সরস্বতী
সোনার হার তাঁর যেমন পরিচয়, তেমনই তাঁর পরিচয় সোনালি সুরের সফর। সেই ‘ডিস্কো ডান্সার’ থেকে ‘ডার্টি পিকচার’ পর্যন্ত- সুরের যে ডালি তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেলেন, তা ভারতীয় সঙ্গীত জগতের চিরকালীন সম্পদ। সোনার ঔজ্জ্বল্যও হয়তো কমে, কিন্তু সুরের সেই ঐশ্বর্য কখনও ম্লান হয় না।