কথা কানে গেল প্রিন্সিপাল রেভারেন্ড হেসটির। তিনি এবার ছাত্রদের কাছে এলেন। এসে বললেন, অধ্যাপক বললেন বটে ছাত্ররা নির্বোধ, তারা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা বুঝতে পারে না, কিন্তু মনে হয় অধ্যাপক নিজেও ওয়ার্ডসওয়ার্থকে বোঝেন না। ওয়ার্ডসের মাঝমধ্যে সমাধি হত। এইভাবে ছাত্রদের অনেকক্ষণ বোঝালেন অধ্যাপক হেসটি। সেই বক্তৃতার শেষে তিনি একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এমন একজন ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে আছেন, যিনি সমাধিপ্রাপ্ত হন। তোমরা গিয়ে দেখে এস।
ঠাকুরের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের সম্পর্ক যে একেবারেই অন্যরকম, তা তো ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে আমাদের কাছে। অন্য ভক্তরা তার কিছু কিছু টের পান। তবে সম্পর্কের সেই গভীরতা হয়তো তেমন করে অনুমান করতে পারেন না। এমনকী নরেন্দ্রনাথের কাছের মানুষ যাঁরা, তাঁরাও সম্ভবত সেভাবে বুঝতে পারেননি এই বিষয়টিকে।
শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৬): ঠাকুর চোরকে বলেন চুরি করতে, গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে!
সেই যেদিন কলেজে প্রথমবার রামকৃষ্ণের কথা শুনেছিলেন নরেন্দ্রনাথ, তখন ভাবতেও পারেননি যে, ওই মানুষটার সঙ্গেই অপূর্ব বন্ধনে জড়িয়ে পড়বেন তিনি। ১৮৮০-তে নরেন্দ্রনাথ ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সিতে। বেশ সেজেগুজেই কলেজে যেতেন তখন। পরনে চাপকান ইজের। পকেটে সুইসমার্কা ঘড়ি। এই নরেন্দ্রনাথই তো ঠাকুরের ছোঁয়ায় বদলে যাবেন পুরোপুরি। উত্তরকালে হয়ে উঠবেন সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। সে অনেক পরের কথা। আমরা ফিরে যাই তাঁর কলেজজীবনে। প্রেসিডেন্সিতে অবশ্য বেশিদিন পড়াশোনা হল না নরেন্দ্রনাথের। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন সে সময়। ফলে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস বেশিদিন করতে পারলেন না। ক্লাসে হাজিরা তেমন না থাকায় কলেজ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিল না।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৪): অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বুঝলেন নরেন্দ্রনাথ
নরেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, এবার ইংল্যান্ড চলে যাবেন, সেখানে গিয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করবেন। কিন্তু রাজি হলেন না তাঁর বাবা। বললেন, নরেন্দ্রনাথ কাছে না থাকলে তিনি বাঁচবেন না। অগত্যা নরেন্দ্রনাথকে সাময়িক সে ভাবনা ত্যাগ করতে হল। তিনি এবার ভর্তি হলেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশনে, যা হল আজকের স্কটিশচার্চ কলেজ। এই কলেজে পড়াকালীনই একদিনকার ঘটনা। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থকে ছাত্ররা বুঝতে পারেননি। তাই বেশ রুষ্ট হয়েছেন ইউওরোপীয় অধ্যাপক। রেগেমেগে তিনি টেবিল চাপড়ে, বুট সমেত পা পাদানিতে ঠুকে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৩): ঠাকুরের স্পর্শে আচ্ছন্ন নরেন্দ্রনাথ… মা ভাবলেন, ছেলে বুঝি বাঁচবে না!
কথা কানে গেল প্রিন্সিপাল রেভারেন্ড হেসটির। তিনি এবার ছাত্রদের কাছে এলেন। এসে বললেন, অধ্যাপক বললেন বটে ছাত্ররা নির্বোধ, তারা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা বুঝতে পারে না, কিন্তু মনে হয় অধ্যাপক নিজেও ওয়ার্ডসওয়ার্থকে বোঝেন না। ওয়ার্ডসের মাঝমধ্যে সমাধি হত। এইভাবে ছাত্রদের অনেকক্ষণ বোঝালেন অধ্যাপক হেসটি। সেই বক্তৃতার শেষে তিনি একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এমন একজন ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে আছেন, যিনি সমাধিপ্রাপ্ত হন। তোমরা গিয়ে দেখে এস। সেই প্রথম ওইরকম পরিসরে উঠে এল রামকৃষ্ণের নাম। বলা যায়, শিক্ষিত সমাজে হেসটি সাহেবই রামকৃষ্ণের কথা প্রথম প্রচার করেছিলেন।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১২): ঠাকুরের সঙ্গেও তর্ক করতেও ছাড়তেন না যুবক নরেন্দ্রনাথ
সেই সময়টায় তথাকথিত হিন্দু ধর্মের ভিতর থেকে উঠছে পরিবর্তনের ঢেউ। যাঁরা সংস্কারে আগ্রহী, তাঁদের একদল প্রায় কোনও নিয়মকানুনই মানছেন না। সব কিছুকে অস্বীকার করছেন। পাশাপাশি প্রচার পাচ্ছে ব্রাহ্মসমাজের ভাবধারা। যা গোঁড়ামিমুক্ত ঈশ্বর উপাসনার কথা বলছে। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে বক্তৃতা করছেন কেশব সেন। তাতে অনেকে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ব্রাহ্ম হচ্ছিলেন। তরুণ শিক্ষিত যাঁরা, তাঁরা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন স্বাভাবিক ভাবেই। নরেন্দ্রনাথও ছিলেন সেই দলে। অনেকবার তিনি বলেওছিলেন, যে, ঠাকুরের সঙ্গে দেখা না হলে তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রচারকই হতেন। ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হওয়াতেই একটা অন্য পথের সন্ধান পেলেন নরেন্দ্রনাথ। যে পথ কোনও ধর্মকেই অস্বীকার করছে না। বরং আমাদের যা সনাতন ঐতিহ্য, তা স্পর্শ করেই সংস্কারের দিকে এগোচ্ছে। গোঁড়ামিহীন একধরনের উদার ধর্মবোধের সন্ধান পাচ্ছেন নরেন্দ্রনাথ, যার খোঁজ এতদিন তিনি পাচ্ছিলেন না। ঠাকুর তাই তাঁকে আকর্ষণ করেছিলেন চুম্বকের মতো।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১১): অন্য ভক্তদের সঙ্গে তর্ক করুক নরেন্দ্রনাথ, এ যেন ছিল ঠাকুরেরও ইচ্ছা
তারপর তো দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গা দিয়ে কত জলই না গড়িয়ে গেছে। সেই যে প্রতিবেশী সুরেশচন্দ্র মিত্রর বাড়িতে দেখা হল ঠাকুরের সঙ্গে, গান শোনালেন ঠাকুরকে, তারপর থেকেই এক নতুন সম্পর্কের সূত্রপাত হল। যার হদিশ পান না কেউ-ই। নরেন্দ্রনাথ তাই যখন বলেন, শরীরের ভিতর থেকে ঠাকুর তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দক্ষিণেশ্বরে বসিয়ে রাখেন, উপদেশ দেন – আমরা বুঝতে পারি এ এক এমন সম্বন্ধ যা সাধারণের বোঝার বাইরে। আর ঠাকুর এমনই মানুষ যে সে কথা কাউকে বুঝতেও দেননি। একদিনের ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়। তখন ঠাকুর বেশ অসুস্থ। ডাক্তার তাকে কথা বলতে মানা করেছেন। তখন নরেন্দ্রনাথের পিতাও গত হয়েছেন। স্বচ্ছল দিন উবে গেছে। জ্ঞাতিবিবাদে তিনি জর্জরিত। ঠাকুরের কাছে গিয়ে তিনি দীর্ঘদিন পড়ে থাকেন। বাড়ি ফেরেন না। মা-র চিন্তায় চিন্তায় দিন কাটে। ভাবেন, ছেলে বুঝি সন্ন্যাসী হয়ে গেল। একদিন নরেন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে আনতে তিনি গেলেন কাশীপুরে, দেখা করলেন ঠাকুরের সঙ্গে। তাঁকে দেখেই ঠাকুর বললেন, ‘আপনি এসেছেন ভালই হয়েছে। নরেন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গিরিশ ওরা সকলে মিলে ওকে সন্ন্যাসীর পোশাক পরিয়েছিল। কিন্তু আমি তখনই বাধা দিয়ে বলেছিলেম, তা কেমন করে হয় নরেন – তোমার বিধবা মা, শিশু ভাই রয়েছে। তোমার তো সন্ন্যাসী হওয়া সাজে না।’
সেদিন মায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরছেন। গাড়িতে তাঁর মা ঠাকুরের এই কথাটি বললেন। সব শুনে নরেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, ‘তিনি চোরকে বলেন চুরি করতে, গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে।’ বোঝাই যায়, ঠাকুর আর নরেন্দ্রনাথের যে আত্মিক সম্পর্ক – সে কেবল তাঁদের নিজস্ব। বাইরের কেউ চাইলেও যেন তা স্পর্শ করতে পারে না। কেবল অনুভব করা যায় মাত্র।