কর্মক্ষেত্র আসলে আরেকটা বাড়ির মতোই। কিন্তু সেখানেও বিপন্ন হন অনেক মেয়েই। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার মুখোমুখি হলে ভারতীয় আইনে কীভাবে সুরক্ষা পেতে পারেন নারীরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
আর জি কর কাণ্ডের জেরে যে প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি করে চর্চায় উঠে এসেছে, তা হল, কর্মক্ষেত্রেও আদৌ কতখানি সুরক্ষিত মেয়েরা? রাস্তায় নারীর শরীর ছোঁয়ার জন্য ওঁত পেতে থাকে অনেক হাত। সে কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তা বলে চার দেওয়ালের অফিসঘর? সংগঠিত কর্মক্ষেত্র? যেখানে দিনের অধিকাংশ সময়টাই কেটে যায়, যেখানে কাজে গল্পে বিবাদে উৎসবে লেখা হয় সুখ দুঃখের বয়ান, সেখানেও নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে হবে মেয়েদের? তাই এই পরিস্থিতিতেই এ কথাও মনে করে নেওয়া দরকার যে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার মুখোমুখি হলে ভারতীয় আইনে কীভাবে সুরক্ষা পেতে পারেন নারীরা?
আরও শুনুন:
রাতের পথে কেবল ধর্ষকের অধিকার নাকি! বহু আগেই শুরু ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ আন্দোলনের
কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন হয়রানির বিষয়টিতে প্রথম আলো ফেলেছিল বিশাখা অ্যান্ড আদারস ভার্সেস স্টেট অফ রাজস্থান মামলাটি। যেখানে রাজস্থান সরকার এবং কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে কর্মরতা নারীর সুরক্ষা দাবি করেছিলেন মেয়েরাই। কারণ তার আগে, ১৯৯০-এর দশকে, রাজস্থান রাজ্যের সরকারি কর্মচারী ভামরি দেবী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। নারী উন্নয়ন কর্মসূচির কর্মী হিসেবে একটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করার দরুন এই ছিল তাঁর শাস্তি। দরিদ্র এবং কুমোর সম্প্রদায়ের একজন মহিলার এত সাহস উঁচু জাতের পুরুষদের সহ্য হয়নি। কিন্তু রাজস্থান হাই কোর্টের বক্তব্য ছিল, উঁচু জাতের পুরুষেরা নিচু জাতের মেয়েদের ছোঁবেই না, ধর্ষণ তো পরের কথা। সুতরাং, এই ধর্ষিতা নারী বিচার পাননি। যেমনটা পান না অনেক ভারতীয় নারীই। কিন্তু তাঁর এই পরিণতিই কর্মরতা মেয়েদের যৌন সুরক্ষার ব্যাপারে ভাবনা উসকে দিয়েছিল। আর সেখান থেকেই ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা, আর অবশেষে বিশাখা গাইডলাইনের যুগান্তকারী রায়।
কী আছে এই গাইড লাইনে?
নির্দেশিকায় তিনটি বিষয়ের ওপর স্পষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। নিষেধ (প্রহিবিশন), প্রতিরোধ (প্রিভেনশন) এবং প্রতিকার (রিড্রেস)। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় বলা রয়েছে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্তা হলে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। ২০১৩-এর আইন অনুযায়ী ১০ কিংবা তার বেশি সংখ্যক কর্মী রয়েছে এমন সংস্থার নিয়োগকর্তার ইন্টার্নাল কমপ্লেইন্টস কমিটি বা আইসিসি গঠন করা বাধ্যতামূলক। এই আইনের আওতায় পড়বে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। একসময় বিশাখা গাইডলাইনে শুধুমাত্র চাকুরিরতা মহিলাদেরই উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির লড়াইয়ের মাধ্যমে যুক্ত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলাদের সমস্যাও। সুতরাং যাঁরা মাঠে-ঘাটে, ইটভাটায়, বা নির্মাণ শিল্পে, রাস্তা তৈরিতে কাজ করে থাকেন, দিনমজুরি করেন, তাঁরাও বিশাখা গাইডলাইনের আওতায়। শুধু মহিলা কর্মীরাই নন, বিশেষ কোনও কাজে সংস্থায় এসেছেন এমন মহিলাও এই আইনের আওতায় পড়েন।
যৌন হেনস্তার আওতায় কী কী পড়বে তাও বলা হয়েছে এই সূত্রে-
শারীরিক ছোঁয়া এবং তার থেকে বেশি অবাঞ্ছিত আচরণ
যৌনতার দাবি
যৌন মন্তব্য
পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করা
যে কোনও মৌখিক, শারীরিক, আচরণগত যৌন হেনস্তা
মহিলার যৌন জীবন নিয়ে বারবার প্রশ্ন বা মন্তব্য করা, আপত্তিজনক যৌনতাপূর্ণ এমএমএস, ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ছবি কিংবা পোস্টার দেখানো।
যৌন পক্ষপাত দাবি করে কোনো মন্তব্য করা, হুমকি দেওয়া, প্রতিবাদ করলে তার উদ্দেশ্যে যৌন মন্তব্য করা
এই সবকিছুর পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রের পরিসরে ফ্লার্টিং বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে।
আরও শুনুন:
নির্যাতনের দামে কেনা, তাই খোলা আকাশের অধিকার মেয়েদেরও
কোনও মহিলা কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হলে তিনি ‘বিশাখা গাইডলাইন’-এর ভিত্তিতে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। এর বলে কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবে নির্যাতিত হলেও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। দোষীকে চিহ্নিত করা এবং শাস্তি দেওয়ার নির্দেশও দেয় এই আইনি প্রক্রিয়া। কিন্তু সমস্যা হল, এ সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন মানসিকতার বদল। অনেক নারীই যৌন হেনস্তার ঘটনায় ভয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যান, কারণ সমাজ তাঁদের এ নিয়ে লজ্জা পেতেই বাধ্য করেছে। সেখানে স্পষ্ট অভিযোগ জানিয়েই উঠতে পারেন না অনেকে। আবার উলটোদিকে যে কর্তৃপক্ষ গাইডলাইন মেনে অভিযোগের তদন্ত করবেন, সেখান থেকেই ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলে পুরো লড়াইটাই কঠিন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া অসংগঠিত ক্ষেত্রে, বা পরিযায়ী শ্রমিকদের বেলায় বিশাখা গাইডলাইন সম্পর্কে সচেতনতা এখনও বহুদূরে। তবুও, কর্মরতা নারীর হেনস্তার ক্ষেত্রে এই আইন যে একটি বড় অস্ত্র হতে পারে, তা অস্বীকার করা চলে না।