প্রতিটি নারী নির্যাতন আমাদের যত বিপন্ন করেছে, তত সেই পথচলারও রসদ জুগিয়েছে। রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে সেই চলার অধিকার কিনেছেন মেয়েরা। নৃশংসতার বিচারে পাশ করে যাওয়া প্রতি ধর্ষণের পর সে অধিকারে বেড়া টানার রব ওঠে। লিখছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
এলাটিং বেলাটিং সই লো, রাজামশাই একটি বালিকা চাইল— চাইলেই পাওয়া যায় বইকি। বালিকারা তো স্রেফ পুতুলের মতো। মাটির তাল, কাপড়ের দলা। চাইলেই ‘নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও’ বলে রাজার পছন্দের বালিকাকে যূথের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়াই দস্তুর। যে সমাজে শিশুর পুতুলখেলাতেও এই অধিকারের বয়ান জারি থাকে, সে সমাজে আমরা কীভাবে প্রশ্ন তুলতে পারি যে, ‘ধর্ষণ কেন হয়?’
একটা ধর্ষণ নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে পড়তে থাকে আগেরটার কথা। আগের আগেরটার কথা। আসলে বিষয়টা তো পুরনো নয় মোটেই। বিষয়টা নতুনও নয়। এ এক ধারাবাহিক অভ্যাস। সে ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছলে আমরা কেঁপে উঠি। খেপে যাই। ফেসবুকের ডিপি কালো হয়। প্রতিবাদী পোস্ট। মোমবাতি মিছিল। মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে শেষ হওয়ার আগেই অন্য কোনও মেয়ে অন্য কোথাও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কে জ্বলছে, সে প্রশ্ন আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে। মেয়েরা জানে, সে প্রশ্ন ফিকে হওয়ারই কথা ছিল, কেন-না সে প্রশ্ন আদৌ নতুন নয়, আর সে প্রশ্ন পুরনোও হবে না। বাকি সমাজের মনে রাখার দায় নেই, আর মেয়েদের দায় বেঁচে থাকার। না ভুলে গেলে প্রতি মুহূর্তে ভয় আর অবিশ্বাস নিয়ে তারা বাঁচবে কেমন করে! ধর্ষণ সংস্কৃতির মধ্যে রোজ বেঁচে থাকে তারা। রোজ রোজ শরীর চেটে নেওয়া চাহনি, শরীরে বুলিয়ে যাওয়া হাত, উড়ো যৌনগন্ধী মন্তব্য তারা গিলে নেয়। রকে বসা ছোকরা থেকে দামি মোবাইল হাতে যুবক, কিংবা মধ্যবয়স্ক সহযাত্রী, যে কারও কাছ থেকে। গিলতে গিলতে শেখে, পা ঢেকে বসতে হয়। জানে, শাড়ির আঁচল সরে গেলে লোকে বলবে ‘ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়ানো মেয়ে’। শোনে, তাকেই পালটা মারতে হবে, তাকেই প্রত্যাঘাত শিখতে হবে, তাকেই অস্ত্র ধরতে হবে— সব, সব শুধু তার দায়। পুরুষের সম্মান শেখার দায় নেই, সমাজের মানসিকতা বদলানোর দায় নেই, আইনের তৎপর হওয়ার তাড়া নেই। তাই, একটি ধর্ষণ থেকে আরেকটি ধর্ষণের দিকে যেতে যেতে, মাঝের সময়টুকুতে মেয়েরা সব ভুলে গিয়ে একটু শ্বাস নিতে চায়।
:আরও শুনুন:
মেয়েদের দাম কত! শাসক থেকে বিরোধী, সব পথ শেষে মিলে যায় একই প্রশ্নে?
২০০০ সালে ‘Women, Gender and the State’ বইতে সন্ধ্যা আর্য বলেছিলেন, আটের দশকের নারী সংক্রান্ত আইনে যা কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল, তা ভারতীয় নারীর সামাজিক অবস্থান বদলাতে আদৌ সাহায্য করেনি। বরং আইনই নারীকে সহনাগরিক, সমনাগরিকের মর্যাদা না দিয়ে তাকে ‘পারিবারিক মর্যাদা’, ‘ মেয়ে-মা-বোন’, ‘পরনির্ভরশীল’ ইত্যাদি পিতৃতান্ত্রিক রেটরিকে বন্দি করে ফেলেছে। যেখান থেকে ‘খারাপ মেয়ে’ আর ‘ভালো মেয়ে’-র বাইনারি সমাজে আরও চেপে বসেছে, প্রকারান্তরে বলা হয়েছে পিতৃতান্ত্রিক মাপকাঠিতে পাশ করা লক্ষ্মী মেয়েরাই সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য। অন্যরা খাটো পোশাক, প্রেমে পড়া, পুরুষ বন্ধু থাকা, রাতে বাড়ির বাইরে বেরনো ইত্যাদি নানাবিধ কারণেই খারাপ। মনে আছে, নির্ভয়ার ধর্ষক আর তার আইনজীবী উভয়েরই বক্তব্য ছিল, এহেন মেয়েদের ধর্ষণ করাই উচিত? ধর্ষক হয়তো একক ব্যক্তি হতে পারে, কিন্তু সে আসলে এই সমষ্টির অন্তর্গত। সেই সমষ্টি, যেখানে জ্যোতি-আসিফার ধর্ষকেরা দাঁড়িয়ে থাকে, জ্যোতির বিপক্ষের আইনজীবী কিংবা আসিফার ধর্ষকের পক্ষে মিছিল করা গেরুয়া পতাকা দাঁড়িয়ে থাকে, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের রেহাই দিতে চাওয়া পুলিশ, নেতা আর বিচারপতিরাও থাকেন, আবার ট্রেনে-বাসে ‘মেয়েটাই দায়ী’ বলা নারী-পুরুষেরাও থাকেন। তর-তম বিচার করাই যায়, তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে আসলে এঁরা সকলে মিলে গড়ে তোলেন এক ধর্ষণ সংস্কৃতি। নিজেদের বৃত্তের কোনও নারী, নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনও নারী ধর্ষিতা হলে নিজস্ব ভয় ও অসহায়তা থেকেই সমাজে এক বড় ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয় বটে, কিন্তু তাতে ওই সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব আদৌ নেই হয়ে যায় না। আর যায় না বলেই, পরের ধর্ষণের সম্ভাবনাও জেগে থাকে আগের ধর্ষণের আবহেই।
তাই, প্রতিটি ধর্ষণের আবহেই, আসলে ওই কর্তার ভূতের সঙ্গে লড়াইতেই জোর দেওয়া জরুরি। মেয়েদের সামনে লক্ষ্মণরেখা টানায় নয়। তাকে বাঁচানোর যুক্তিতে, তার সুরক্ষার যুক্তিতেও তার সামনে গণ্ডি টেনে দেওয়া জায়েজ হতে পারে না। শত শত বছর ধরে এই সমস্ত নির্যাতনের জুজু দেখিয়েই মেয়েদের থামিয়ে রাখতে চাওয়া হয়েছে, আর শত শত বছর ধরে এই সমস্ত নির্যাতনের আগুনের উপর দিয়েই হাঁটছে মেয়েরা। দিনে, রাতে। ধর্ষিতা হয়ে, মার খেয়ে, মরে গিয়েও। হাঁটতে হাঁটতেই তারা মারের মুখের উপর দিয়ে ফুল বিছিয়ে দিচ্ছে উত্তরনারীদের এগিয়ে আসার জন্যে। বুলগেরিয়ার বামপন্থী নেত্রী ব্লাগা দিমিত্রোভা লিখেছিলেন—
“পেছনে তাকিও না।
প্রতিটি পদক্ষেপ নিচ্ছ
বিশ্বাসের শপথ নিয়ে
সেই ছায়াচ্ছন্ন মূর্তির প্রতি
যার ভয় ওরা তোমাকে বহুদিন দেখিয়ে এসেছে।
পাথরে তোমার পায়ের শব্দ ওঠে।
একাকী নারী, রাস্তায়
সবচেয়ে পেলব আর সবচেয়ে সাহসী পা ফেলছ
অপমানিতা মা ধরিত্রীর বুকে।
সেও, আরেক একাকী নারী। রাস্তায়। (অনুবাদ: যশোধরা রায়চৌধুরী)
রাস্তায় একাকী পা ফেলার এই অধিকার মেয়েদের এই যাবতীয় নির্যাতনের অর্জন। প্রতিটি নারী নির্যাতন আমাদের যত বিপন্ন করেছে, তত সেই পথচলারও রসদ জুগিয়েছে। রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে সেই চলার অধিকার কিনেছেন মেয়েরা। নৃশংসতার বিচারে পাশ করে যাওয়া প্রতি ধর্ষণের পর সে অধিকারে বেড়া টানার রব ওঠে। কখনও ভয়ে, কখনও ভিক্টিম ব্লেমিংয়ে। কেউ বলেন, ‘এজন্যই বাড়ি থেকে রাতে বেরোতে বারণ করে’, আর কেউ বলেন ‘মেয়েদের রাতে বেরোনোর দরকারটাই বা কী!’ অথচ প্রতিটি নারী নির্যাতন আদতে সে অধিকার কেড়ে নেওয়ারই ষড়যন্ত্র। তাই ভয়েই হোক আর ভাবনাতেই হোক, এমন কোনও কথা না বলা হোক, যা সেই স্বাধীনতা রুখে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
আরও শুনুন: আঁচল সরলেই ‘মন্দ মেয়ে’র উপাখ্যান! যেন প্রাচীন মুদ্রাদোষ
স্বাধীনতার মানে আসলে অনন্ত নক্ষত্রের রাত। নক্ষত্র ভরা রাতের আকাশ দেখতে পাওয়ায় মুক্তির নিশান ওড়ে। মনে পড়ে যায় মাজিদ মাজিদির ‘বিয়ন্ড দ্য ক্লাউডস’ ছবির কথা। যেখানে এক মা-হারা শিশুকে তারায় ভরা আকাশ দেখতে নিয়ে গিয়েছিল সেই মেয়েটি, নিজের ধর্ষিতা হয়ে যাওয়া রুখতে যে আক্রমণকারীকে আঘাত করেছিল। সম্ভাব্য ধর্ষকের মরে যাওয়ার দরুন সে মেয়েকেই জেলে পুরেছিল আইন। তেমনই বন্দিনী মায়ের জেলে জন্মানো সন্তান হওয়ার দৌলতে ওই শিশুটিও কোনও দিন দশ ফুট বাই দশ ফুটের কুঠুরির ছাদের ওপরে কোনও আকাশের খোঁজ পায়নি। নিজের একমাত্র সম্বল আংটিটির বিনিময়ে তাকে আকাশ দেখানোর পরোয়ানা কিনেছিল সে মেয়ে। ছোট্ট একটু ফাঁক থেকে শিশুটির পাশাপাশি সেও ফের আকাশ দেখছিল। সে আকাশ থেকে তখন বৃষ্টি ঝরছিল অঝোরে। সে বৃষ্টি হয়তো ধর্ষণের মুখে পড়া মেয়ে, জেলে সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হওয়া মেয়ে, জেল হেফাজতে যে মেয়েদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার খবর বেরোয়, তাদের সকলের সমবেত কান্না। সে আকাশে সব তারা মেঘের গভীরে ঢাকা থাকুক, কিংবা সে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ুক, তবু সে আকাশে তাদেরও অধিকার।