বিশ্বকাপের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মণিমুক্তো। কিছু তার মনে আছে, কিছু বা ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির কুয়াশায়। মাঠ আর মাঠের বাইরের নানা রঙের চরিত্রদের ফিরে দেখা চলতি বিশ্বকাপের মরশুমে। এই বিশ্বকাপ যেন মেসির বিশ্বকাপ হতে চলেছে, অনেকে এমনটাই বলছেন। প্রায় একাই আর্জেন্টিনাকে ট্রফির দিকে টেনে নিয়ে চলেছেন কিংবদন্তি। অথচ এই আর্জেন্টিনাই ২৪ বছর অংশ নেয়নি বিশ্বকাপে। কেন জানেন? সেই গল্পই শোনাচ্ছেন সৌরাংশু।
‘ওরিউন্ডি’ কাদের বলে জানেন? স্প্যানিশ, ইতালীয় বা পর্তুগিজ ভাষায় এক বিশেষ ধরণের শরণার্থীদের এই তকমা দেওয়া হয়। এমনি এমনি না, ধরুন, লাতিন আমেরিকার কোনও দেশ থেকে কেউ ইতালিতে এসেছেন, যাঁর শিকড় ছিল আবার ইতালিতেই। তাঁকে যদি ইতালির নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তাহলে দেশজ ভাষায় তাঁকে ‘ওরিউন্ডি’ বলে ডাকা হবে। এই ওরিউন্ডিদের নিয়েই এবারের বিশ্বকাপের গল্প।
আরও শুনুন: বিছানার নিচে জুতোর বাক্সে লুকোনো ছিল বিশ্বকাপের ট্রফি, কিন্তু কেন?
আসলে উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকেই ইতালির সংযুক্তিকরণ নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়। তার আগে পর্যন্ত ইতালি ছিল কয়েকটি নগররাষ্ট্রের সমাহার। নেপোলিয়ন দখল করেছিলেন এদের। ১৮১৪-তে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর, ধীরে ধীরে ইতালির সংযুক্তিকরণের আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। প্রধানত দুই জিউসিপ্পে অর্থাৎ মাৎসিনি আর গ্যারিবল্ডির নেতৃত্বে। তারপর বেশ কয়েকটি গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষদিকে এসে ইতালির পুনর্সংযুক্তিকরণ সম্ভব হয়।
আরও শুনুন: সিগন্যাল দেখেই এল ভাবনা, ফুটবলে চালু হল লাল আর হলুদ কার্ডের শাসন
কিন্তু এই যে সুদীর্ঘ ষাট সত্তর বছরের সময়কাল, সেই সময় দেশের অর্থনীতির অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইতালির জনসাধারণ জীবিকার খোঁজে পাড়ি দিলেন সুদূর দক্ষিণ আমেরিকায়। দক্ষিণ আমেরিকা তখন স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ কবল থেকে স্বাধীন হয়েছে, বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে এবং শিল্পায়ন ও নগরায়ন হচ্ছে। বিশেষত ট্রেন লাইন পাতার কাজ চলছে ব্রিটিশদের উদ্যোগে। ইতালীয়রা এখানে এসে ভিড় করলেন জীবিকার সন্ধানে। ফুটবলও ব্রিটিশদের হাত ধরে তারই আগে-পরে এসে হাজির হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। মূলত প্লাতা নদীর মোহানায়। যার একদিকে বুয়েনস আয়রেস আর অপর দিকে মন্টেভিডিও, অর্থাৎ যথাক্রমে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের রাজধানী। দেখবেন, উরুগুয়ে এবং আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে প্রচুর ইতালীয়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। দিয়েগো মারাদোনা, এঞ্জো ফ্রাঞ্চিকোলি, আলফ্রেদো দি স্তিফানো, ড্যানিয়েল পাসারেলা, এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো, জ্যাভিয়ের জানেত্তি, এমন কি লিয়নেল মেসির মা-র দিক থেকেও ইতালীয় সংযোগ রয়েছে।
আরও শুনুন: বার দুয়েক চুরি হয়েছিল বিশ্বকাপের ট্রফি, উদ্ধারের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও
তা এই ইতালীয়দের নিয়েই সমস্যা তৈরি হয়েছিল তিনের দশকে। আর সেই গণ্ডগোল থেকেই আর্জেন্টিনা চব্বিশ বছর বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি। হয়েছিল কী, প্রথম অলতলান্তিক মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বমঞ্চে ফুটবল শিল্প নিয়ে হাজির হয় উরুগুয়ে, ১৯২৪-এ। প্যারিসে। এবং সবাইকে স্কিল দিয়ে চমকে দিয়ে তারা অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নও হয়। তাদের পিছন পিছন পরের অলিম্পিকে আমস্টারডামে হাজির হয় আর্জেন্টিনা। এবারে উরুগুয়ে চ্যাম্পিয়ন হলে আর্জেন্টিনা রানার্স। দু’বছর পরে যে বিশ্বকাপ শুরু হল উরুগুয়ের মাটিতে, সেখানেও একই ফলাফল। কিন্তু সেই বিশ্বকাপে ইউরোপ থেকে যুগোস্লাভিয়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম আর রোমানিয়া ছাড়া কেউ অংশ নেয়নি। ফলত উরুগুয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা ১৯৩৪-এর ইতালি বিশ্বকাপ বা ১৯৩৮-এর ফ্রান্স বিশ্বকাপে অংশ নেবে না।
আরও শুনুন: এক ম্যাচে বিপক্ষকে ১০ গোল! বিশ্বকাপে প্রথম এই কৃতিত্ব কোন দেশের?
আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে কিন্তু এই ব্যাপারটা ছিল না। তারা দুর্দান্ত খেলে ১৯২৮-এর অলিম্পিকে আর প্রথম বিশ্বকাপে রানার্স হয়েছে। কিন্তু তাদের খেলোয়াড়দের উপর নজর গেছে ইতালির। বিশেষত জুভেন্তাস, মিলান প্রমুখ ক্লাবের। তারা ইতালীয় বংশোদ্ভূতদের ইতালির ক্লাবে ভালো রকম অর্থের বিনিময়ে খেলার প্রস্তাব দিয়েছে। খেলোয়াড়দেরও রোজগারে আপত্তি কীসের! আর শিকড়ের প্রতি টান একটা রয়েইছে। তার ঠিক পর পরই ১৯৩৪-এর ইতালি বিশ্বকাপ। হিটলারের যেমন ছিল ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিক্স, ইতালির একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির তেমনই ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপ। যেনতেন প্রকারেণ তাঁকে জিততেই হবে। তাঁর প্রচ্ছন্ন মদতে ইতালির কোচ ভিত্তোরিও পুজ্জো ইতালি দলে খেলার প্রস্তাব দিলেন রেমুন্ডো ওরসি, লুই মন্টি আর এনরিকো গুয়েতাকে। এঁরা ইতোমধ্যেই ইতালির বিভিন্ন ক্লাবে খেলছেন এবং একই সঙ্গে আর্জেন্টিনার হয়ে অলিম্পিক ও বিশ্বকাপ ফাইনালিস্ট। বিশেষত মন্টির দুরন্ত পারফরম্যান্সে ইতালি ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপ জিতল আর আর্জেন্টিনা প্রধান তিন খেলোয়াড়ের নিষ্ক্রমণে দুর্বল হয়ে গ্রুপ স্টেজ থেকেই বিদায় নিল।
আরও শুনুন: দুই বিশ্বকাপের মাঝে থাকে ৪ বছরের বিরতি, জানেন কেন?
যদিও মুসোলিনি বিশ্বকাপ বিজয়ীদের সম্বর্ধনা দেওয়ার সময় নিশ্চিত করেন যে, এই তিনজন যেন ডাক না পান। কিন্তু এই ঘটনায় আর্জেন্টিনা এমনই দমে গেল যে তারা বিশ্বযুদ্ধের সময়টুকু ছেড়ে পরবর্তী তিনটে বিশ্বকাপে দলই পাঠাল না। অবশ্য সেখানে আর্জেন্টিনার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও একটা বড় কারণ ছিল। রিভারপ্লেট ও বোকা জুনিয়র্সের মধ্যে চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দিতা এই সময়ই গড়ে উঠেছিল, কিন্তু সেরা সেরা খেলোয়াড়দের বিশ্বকাপে খেলা হয়নি। ১৯৫৮-তে সুইডেন বিশ্বকাপ থেকে আবার তারা বিশ্বকাপে অংশ নিতে শুরু করে। মাঝের ওই কয়েকটা বছর বিশ্বকাপ ঠেকে অনুপস্থিতই ছিল আর্জেন্টিনা।