লাগাতার যুদ্ধে বিপর্যস্ত ইউক্রেন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া সামরিক অভিযান ঘোষণা করার পর থেকে কেটে গিয়েছে দশ দিন। একের পর এক শহরে বোমা ফেলেছে পুতিনের দেশ। রাস্তায় টহল দিচ্ছে রুশ সেনা। মাথার উপর চক্কর মারছে বোমারু বিমান। রাজধানী কিয়েভ দখল করতে না পারলেও ইউক্রেনের একাধিক শহরই এখন রুশ বাহিনীর দখলে। কোথায় গিয়ে যে এই যুদ্ধের শেষ, তা জানেন না বাসিন্দারা। তবু মরিয়া চেষ্টা করতে ছাড়ছেন না তাঁরা। রুশ সেনাকে আটকাতে দ্রুত হাতে গড়ে তুলছেন ব্যারিকেড। আর তাতে হাত লাগিয়েছে একেবারে একরত্তিরাও। কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন ইউক্রেনের উপকূল শহরের বাসিন্দারা। আসুন শুনে নিই।
ইউক্রেনের উপকূলীয় শহর ওডেসা। শান্ত, সুন্দর দেশটা এক সপ্তাহের মাথায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সব সময় আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে বাসিন্দাদের। এই বুঝি বোমার বৃষ্টি নামল আকাশ থেকে। এই বুঝি মৃত্যু এসে কড়া নাড়ল দরজায়। ইতিমধ্যে অনেক বাসিন্দাই দেশ ছাড়তে শুরু করেছেন। বেঁচে থাকার আশায় ভিড় জমিয়েছে পড়শি দেশের সীমান্তে।
তবে ওডেসার বাসিন্দারা ব্যাস্ত হাতে আগলাচ্ছেন শহর। গড়ে তুলছেন প্রতিরোধ। বয়স্ক থেকে শিশু- কেউ পিছিয়ে থাকেননি এ কাজে। যে কোনও ভাবে রুশ হামলার হাত থেকে বাঁচাতেই হবে শহরটাকে। তাই মানব-চেন বানিয়ে দ্রুত হাতে বাসিন্দারা বালি ভরছেন বস্তায়। মহিলারা হাতে হাত লাগিয়ে সেসব তুলে দিচ্ছেন ট্রাকে। সে সব বয়ে আনা হচ্ছে শহরের মাঝখানে। গড়ে তোলা হচ্ছে ব্যারিকেড।
আরও শুনুন: যুদ্ধে তছনছ আশ্রয়, রোমানিয়ার বিয়েবাড়িই এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই বহু ভারতীয় পড়ুয়ার
এককালে এই ওডেসা ছিল ইউক্রেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থলগুলির একটি। দেশবিদেশ থেকে পর্যটকেরা আসতেন উপকূল-শহর ঘুরতে। তবে দিন কয়েকের যুদ্ধ সেসব স্মৃতি যেন এক লহমায় মুছে দিয়েছে। এখন শহর জুড়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ব্যারিকেড গড়ার তাড়া।
ইতিমধ্যেই উপকূলীয় শহর খেরসন দখল করেছে রুশ বাহিনী। এখনও মাঝেসাঝেই ওডেসার মানুষের কানে ভেসে আসছে যুদ্ধের সাইরেন। আর সেই শব্দ পেলেই ব্যারিকেড গড়ার কাজ বন্ধ রেখে তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন মাটির নিচের বাঙ্কারে। তার পর সব একটু শান্ত হলেই আবার বেড়িয়ে এসে হাত লাগাচ্ছেন ব্যারিকেড গড়ার কাজে। বাড়ির মহিলারা সদ্যজাতদের রেখে আসছেন মাটির নিচের ওই আশ্রয়েই। স্বাভাবিক জীবনযাপন, সেসব এখন স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে ইউক্রেনবাসীর।
স্কুল নেই, পড়াশোনা নেই। এখন বস্তায় বালি ভরার কাজে ভীষণ ব্যস্ত এগারো বছরের এক খুদে কন্যা। তার মাঝেই কাজ থেকে মুখ তুলে সে জানাল, ওডেসাকে বাঁচাতে পারলেই বাকি সব কিছু আপসেই ঠিক হয়ে যাবে। একরত্তি মেয়ে, সে কতটুকুই বা বোঝে এই যুদ্ধের। তবু নিজের বাড়ি, নিজের শহর বাঁচাতে খুদে কাঁধে তুলে নিয়েছে সে গুরুভার।
আরও শুনুন: আটক রুশ সেনাকে খাবার, মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়ে মানবিকতার নজির ইউক্রেনবাসীর
ইতিমধ্যে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় পরমাণু কেন্দ্রটির দখল নিয়েছে রুশ সেনা। সেখানে রুশ বোমা আছড়ে পড়ে আগুন লেগেছিল বলেও খবর মিলেছে। তেজস্ক্রীয়তা ছড়ানোর আশঙ্কায় কাঁপছে ইউক্রেনবাসী। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার ওডেসা শহরের একটি বন্দর সংলগ্ন এলাকায় একটি জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনায় উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। ইউক্রেন পার্লামেন্টের তরফে টুইট করে জানানো হয়, রুশ গোলার আঘাতেই ডুবে গিয়েছে জাহাজটি। তার পর থেকেই ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে এলাকার মানুষজন। এখনও পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সাড়ে সাতশোরও বেশি সাধারণ মানুষ বলি হয়েছেন। জখমের হিসেব নেই। আশার কথা, রাশিয়ার তরফে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কথা বলা হয়েছে। এবং তা যদি সত্যিই হাতে-কলমে কার্যকর হয়, তবে হয়তো খানিকটা স্বস্তি পাবেন ইউক্রেনের সাধারণ বাসিন্দারা। তবে ওই যে কথায় বলে না, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। তাই যুদ্ধবাজদের আশ্বাসেও ঠিক ভরসা করতে পারছেন না ইউক্রেনবাসী।
তাই রাশিয়াকে প্রতিহত করতে শুধু সরকার বা ইউক্রেনের সেনার উপরে ভরসা করতে পারছেন না ইউক্রেনের মানুষ। কেউ তুলে নিয়েছেন অস্ত্র, কেউ বেছে নিয়েছেন পালানোর পথ। তবে যুদ্ধ বা পালানো কোনও পথেই যাননি ওডেসার মানুষ। বরং নিজেদের মতো করে শহরটাকে বাঁচানোর চেষ্টা শুরু করেছেন তাঁরা। এত সংশয়, এত ভয় তবুও নিজেদের বিশ্বাসে অটল ওডেসাবাসী। শত্রুশক্তির কবল থেকে নিজের দেশকে বাঁচাতে পারবেন বলেই আশায় বুক বেঁধেছেন সেখানকার বাচ্চা থেকে বুড়ো।