রূপকথা আসলে কল্পনায় থাকে না, থাকে ময়দানে। নিজের ঘাম রক্ত দিয়ে সে রূপকথা লিখে ফেলেন কিছু মানুষ, যেমনটা লিখলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। কার্যত এক পায়ে খেলে, ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসে অ-মানুষী এক রান রেকর্ড গড়লেন তিনি। আর তাই, ক্রিকেটদেবতাও তাঁর মাথায় জুড়ে দিলেন আরও একাধিক পালক। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বিশ্বকাপের অগণিত দর্শক তখন প্রায় বুঝেই গিয়েছে, আফগানদের সেমিতে পৌঁছনো আর কেবল সময়ের অপেক্ষা। তালিবান শাসনে ভীতসন্ত্রস্ত একটা দেশের কিছু মানুষ তাঁদের সবটুকু লড়াই উজাড় করে দিচ্ছেন এই ময়দানেই। সেই সময়েই, একা হাতে, বা বলা ভালো এক পায়ে, সেই রূপকথার মুখ ঘুরিয়ে দিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। পায়ে টান লেগে দৌড়নো তো দূর, খেলা চালিয়ে যেতেও কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। তারপরেও যেন ম্যাক্সি মনে মনে জানতেন, স্কোরবোর্ডকে নিজের দলে না এনে মাঠ ছাড়তে নেই। তাই শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া যখন ২৯৩ রানে সত্যিই ম্যাচ জিতে নিল, সেখানে ২০১ রান যোগ করে ফেলেছেন ম্যাক্সওয়েল, একাই। তারপরেও তিনি অপরাজিত। এই অবিশ্বাস্য ইনিংসই হয়তো গোটা বিশ্বকাপের সেরা হয়ে থাকবে, এমনটা বলছেন একাধিক ক্রিকেটবোদ্ধারাই। কিন্তু কেবল এই একটি রেকর্ডেই তো থামেননি অজি ব্যাটার। তাঁর অমানুষিক ব্যাটিংয়ের পুরস্কার জিতে নিয়েছে আরও একাধিক রেকর্ড।
আরও শুনুন: কেবল টাইমড আউট নয়, ক্রিকেট দুনিয়ায় রয়েছে এমনই আরও আজব নিয়ম… জানেন?
রেকর্ডবুক বলছে, ম্যাক্সওয়েলই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ব্যাটার, যিনি ওয়ান ডে ক্রিকেটে ডবল সেঞ্চুরি করলেন। সারা বিশ্বের নিরিখে দেখতে গেলে, এক দিনের ক্রিকেটে একাদশতম ব্যাটার হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করলেন তিনি। তার উপরে তিনিই প্রথম ব্যাটার যিনি ওপেনার না হয়েও এক দিনের ক্রিকেটে দ্বিশতরান করলেন। এর আগের ১০ জনই ছিলেন ওপেনার। শুরু থেকে খেলে ২০০ রান করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু মিডল অর্ডারে নেমে ২০০ রান তোলার নজির এই প্রথম।
ম্যাক্সওয়েল ব্যাট করতে নেমেছিলেন ছয় নম্বরে। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে এই ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমেই ১৭৫ রান করে দলকে জিতিয়েছিলেন কপিলদেব। ছ’নম্বরে ব্যাট করতে নেমে বিশ্বকাপে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ রান। এবার সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন ম্যাক্সি।
আরও শুনুন: পাকিস্তান সেই পাকিস্তানেই! বিরাটকে স্বার্থপর বলে তুলোধোনা প্রাক্তন পাক অধিনায়কের
শুধু কপিলের রেকর্ডই নয়, ম্যাক্সওয়েল ভাঙলেন ইংল্যান্ডের অ্যান্ড্রু স্ট্রসের রেকর্ডও। ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে রান তাড়া করার সময় ১৫৮ রান করেছিলেন স্ট্রস। কিন্তু বিশ্বকাপে রান তাড়া করার সময় সেরা ইনিংস এখন আর স্ট্রসের সেই ইনিংসটি নয়, এবার শীর্ষে উঠে এল ম্যাক্সওয়েলের এই ২০১ রানই।
রান তাড়া করার পাশাপাশি দ্রুত তাড়া করার ক্ষেত্রেও অবশ্য নজির গড়েছেন ম্যাক্সি। বিশ্বকাপে দ্রুততম ডবল সেঞ্চুরির মালিকও এখন তিনিই। ১২৮ বলে দ্বিশতরান করেছেন তিনি।
সত্যি বলতে, এর আগে এক দিনের ক্রিকেটে যে কটি দ্বিশতরান হয়েছে, সবই এসেছে প্রথমে ব্যাট করে। রান তাড়া করার চাপ মাথায় নিয়ে এই প্রথম কোনও ব্যাটার দ্বিশতরান করলেন। ম্যাক্সওয়েল যখন ব্যাট করতে নেমেছিলেন, তখন ৪৯ রানে ৪ উইকেট চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ৯১ রানে ৭ উইকেট চলে যায়। সেই অবস্থা থেকে অস্ট্রেলিয়াকে শুরু খেলায় ফেরানোই নয়, তাকে জয়ের মুখ দেখালেন ম্যাক্সওয়েল।
দিনের শেষে রেকর্ডই কথা বলে। আর অনেক দিনের পরেও, স্মৃতি যখন মুছে যায়, তখনও কথা বলে রেকর্ডই। তবে ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংসকে বোধহয় ভুলতে পারবেন না কোনও ক্রিকেটপ্রেমীই। কেবল রানের নিরিখে নয়। কেবল জয়ের হিসেবে নয়। নিয়তি যখন হারের দিকেই ঠেলছে, সেই সময়ে কোনও মানুষের অ-মানুষী কামব্যাকের রূপকথা লিখে ফেলেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলই। আর তাঁর সেই রেকর্ডকে সহজে ছুঁতে পারবে না রেকর্ডবুকও।