কখনও সূক্ষ্মরূপে ফুলের মাঝে মিশে যান। কখনও বিশালবপু, একলাফে পার করেন সমুদ্র। রামভক্ত হনুমানের এমনই কতশত কাহিনি রামায়ণের ছত্রে ছত্রে। তবে হনুমানের আহত হওয়ার বা পরাজিত হওয়ার কথা খুব এটা শোনা যায় না। আসুন শুনে নেওয়া যাক, সেই অধ্যায়ের কথা।
প্রভু রামের একনিষ্ট ভক্ত। পরম জ্ঞানী, বীর, পণ্ডিত। চাইলেই একলাফে সমুদ্র পার করার ক্ষমতা রাখেন। জেদের বশে সূর্যকেও গিলে নিতে পারেন। সেই হনুমানকেয় আহত হতে হয়েছিল। তাও আবার ভরতের হাতে। রামায়ণের এই কাহিনি তেমন প্রচলিত নয়, তবে হনুমানের আহত হওয়ার ঘটনাতেও সেই রামের মাহাত্ম্যই জড়িয়ে আছে।
পুরাণে যে আট চিরঞ্জীবীর উল্লেখ মেলে, হনুমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মনে করা হয়, তিনি এখনও কোনও নির্জন স্থানে একমনে রামনাম জপ করে চলেছেন অবিরাম। অনেকে দাবিও করেন হনুমানকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছেন। তবে স্বচক্ষে না দেখলেও, ঠিকমতো হনুমানের নাম করলে যে কোনও বিপদ থেকে মুক্তি মেলে। সে প্রমাণ পেয়েছিলেন খোদ মোঘল সম্রাট আকবরও। বলা হয়, ঠিকমতো হনুমানের পুজো করলে কাটে অর্থকষ্ট। যে কোনও বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন এই পবনপুত্র। রামায়ণের ছত্রে ছত্রে তাঁর বীরত্বের কাহিনি রয়েছে। সীতাউদ্ধার পর্বে হনুমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় পৌঁছানো, অপমানের বদলা নিতে সোনার লঙ্কা জ্বালিয়ে দেওয়া, কিংবা অসুস্থ লক্ষ্মণকে বাঁচাতে আস্ত পর্বত কাঁধে করে নিয়ে আসা, হনুমান সবই করেছেন। তাই রামের সঙ্গে তিনিও পূজিত হন বহু মন্দিরে। বীর হনুমান পরাজিত হয়েছেন এমন ঘটনা রামায়ণে নেই বললেই চলে। কিন্তু গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনিও। তাও আবার রামের ভাই ভরতের ছোড়া বাণে।
এই অংশের বর্ণনা মেলে শ্রীরামচরিতমানসে। কবি সেখানে লিখছেন, ‘পরেউ মুরুছি মহি লাগত সায়ক। সুমিরত রাম রাম রঘুনায়ক’। অর্থাৎ ভরতের বাণের আঘাতে হনুমান রাম রাম রঘুপতি বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন ভরত বাণ ছুড়লেন হনুমানকে? তাহলে খুলেই বলা যাক।
শক্তিশেলের ঘায়ে জব্বর আহত হয়েছেন লক্ষ্মণ। জ্ঞান হারিয়েছেন, এবং তা ফেরার আশা ক্ষীন বলেই জানিয়েছেন কবিরাজ। একমাত্র সঞ্জীবনী পাতা পথ্য হিসেবে ব্যবহার করলেই লাভ হতে পারে। তা সেই পথ্য আনার দায়িত্ব পেলেন হনুমান। ছুটলেন গন্ধমাদন পর্বতের খোঁজে। খানিক খোঁজাখুঁজি করে তা পেয়েও গেলেন, কিন্তু মুশকিল হল অন্য জায়গায়। কোনটা সঞ্জীবনী তা হনুমান চেনেন না, অগত্যা গোটা গন্ধমাদন পর্বতটাই কাঁধে তুলে লাফ দিলেন পবননন্দন। রাতের অন্ধকারে বিশাল পর্বত কাঁধে উড়তে থাকলেন। এরকম একটা সময় সেই বিশালবপু হনুমানকে দেখতে পেলেন ভরত। হনুমান তখন অযোধ্যা রাজ্যের খুব কাছ দিয়ে উড়ছেন। ভরত ভাবলেন, এ নিশ্চয় বিকট কোনও রাক্ষস। সঙ্গে সঙ্গে তীর নিক্ষেপ করলেন। উড়ন্ত হনুমানের পায়ে লাগল সেই তীর। অন্য কেউ এমনটা করলে হয়তো হনুমানের কিছুই মনে হত না। কিন্তু রামের ভাই ভরত কিছু কম বীর নন। তাই তাঁর ছোড়া বাণ রীতিমতো আহত করল হনুমানকে। আর্তনাদ করে উঠলেন হনুমান। মাটিতে পড়লেন, মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরোলো রামনাম! এই রামনাম শুনেই সংবিত ফিরল ভরতের। কোনও রাক্ষস নিশ্চয়ই রামের নাম করবেন না! নিজের ভুল বুঝলেন। চিকিৎসার জন্য হনুমানের কাছে ছুটে গেলেন। হনুমানও ভরতের পরিচয় পেয়ে সব ঘটনা খুলে বললেন। অল্প চিকিৎসাতেই সুস্থ হলেন পবননন্দন। আবারও উড়লেন, কাঁধে সেই গন্ধমাদন। এবার অবশ্য পথে কোনও বাধা আসেনি। ঠিক সময় পৌঁছে প্রাণে বাঁচালেন লক্ষ্মণকে। রামায়ণের এই কাহিনি তেমন প্রচলিত নয়। অনেকে বলেন, রামের মাহাত্ম্য বোঝাতে রামচরিতমানসে এমনটা জোড়া হয়েছে। সেই নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তবে হনুমান যে রামের প্রতি নিজের ভক্তি, আনুগত্য প্রমানে কখনও কার্পণ্য করেননি তা বারে বারে প্রমাণ করে এই ধরনের ঘটনা।