তিনি যেমন দশমহাবিদ্যার অংশ। তেমনই বাঙলার আদরিণি শ্যামা। সাধকের কল্পনায় কখনও মাতৃস্বরূপা, আবার কখনও কণ্যাসমা। তবে দেবী কালী মূলত তন্ত্রের দেবী। মন্দিরে বা মণ্ডপেই কালীপুজোর আয়োজন চোখে পড়ে। কিন্তু বাড়িতেও কি এই পুজো করা যায়? আসুন শুনে নিই।
হোক না ঘোর অমাবস্যা, দীপাবলি মানেই আলোর উৎসব। বাজি পোড়ানো থেকে শুরু করে প্রদীপ জ্বালানো, কতই না আলোর নিয়মে ঘেরা এই তিথি। তবে বাঙালির কাছে দিনটা শ্যামা মায়ের আরাধনার দিন। বছরের বিভিন্ন সময় কালী পুজোর চল থাকলেও, কার্তিক অমাবস্যায় মায়ের পুজোর ধুম থাকে অন্যমাত্রায়। অনেকের কাছে স্রেফ এই দিনটাই কালিপুজো হিসেবে পরিচিত।
আরও শুনুন: বসন পরো মা… মাতৃস্বরূপা কালী কেন নগ্নিকা?
যদিও শাস্ত্র বলে, যে কোনও অমাবস্যাই মাতৃ আরাধনার জন্য উপযুক্ত। প্রতি অমাবস্যাতেই দেবীর বিশেষ রূপের পুজো হয়। যেমন রটন্তী, ফলহারিণী কিংবা কৌশিকী অমাবস্যা। তবে কার্তিক অমাবস্যা মূলত শ্যামারূপের আরাধনার দিন। দেবীর এই রূপটি বিশেষভাবে গৃহস্থের পুজো করার জন্য বলা যেতে পারে। তাই লক্ষ্মী, সরস্বতী কিংবা গণেশপুজোর মতোই, শ্যামাপুজো করা যেতেই পারে। যদিও দেবীর পুজো করার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নিয়ম মাথায় রাখা আবশ্যক। বলে রাখা ভালো, এই পুজো বাড়িতে করলেও দিক্ষিত ব্রাহ্মণ ছাড়া করা উচিত নয়। অন্তত শাস্ত্র তেমনই নিদান দেয়। এবার আসা যাক, বাড়িতে দেবীর আরাধনার নিয়মের প্রসঙ্গে।
আরও শুনুন: দেবাদিদেব হয়েও কেন মা কালীর পদতলে থাকেন শিব?
যে কোনও দেবী পুজোর ক্ষেত্রে ষড়োশপচারের নিয়মই প্রচলিত। শ্যামা পুজোও তার ব্যতিক্রম নয়। সাধারণ মন্ডপে যেভাবে দেবীর পুজো হয় ঠিক সেই ভাবেই বাড়িতে দেবীর আরাধনা করা যেতে পারে। উপকরণ হিসেবে লাগবে, সিঁদুর, অধিবাস ডালা, তিল, হরিতকী, দেবী ঘট, একসরা, আতপ চাল। লাগবে ১টি ঘটাচ্ছাদন গামছা, লোহা, শাঁখা-পলা, ১টি কুণ্ডহাঁড়ি, ১টি তেকাঠি, ১টি দর্পণ, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চরত্ন, ১টি সশীষ ডাব, ৪টি তীরকাঠি, পুষ্প, দুর্বা। এই সঙ্গে লাগবে আসনাঙ্গুরীয়ক, মধুপর্কের বাটি, দই, মধু, গব্যঘৃত, চিনি। নৈবেদ্য নিজের ইচ্ছামতো সাজানো যেতে পারে। তবে প্রতি থালায় অন্তত তিনটি ফল এবং একটা মিষ্টি থাকা আবশ্যক। অন্তত ৬ টি থালায় সাজাতে হবে সেই ফল ও মিষ্টি। যা উতসর্গ করা হবে, লক্ষ্মী-নারায়ণ, শিব-দুর্গা, পঞ্চ দেবতা, নবগ্রহ, গুরুদেব এবং দেবী কালীকা। একটি থালায় শুধুমাত্র মিষ্টি সাজানো যেতে পারে। এছাড়া ব্রাহ্মণকে দানের জন্য একটা থামায় কিছু সবজি, চাল-ডাল,ঘি এসব সাজিয়ে রাখুন। এখানেই শেষ নয়, লাগবে কালী ও মহাদেবের জন্য একটি শাড়ি, ধুতি ও গামছা। এছাড়া হোমের জন্য প্রয়োজন, বালি, কাঠ, ঘি, অন্তত ২৮টি বেলপাতা, সমিধ এবং পূর্ণোপাত্র হিসেবে একসরা আতপ চাল, একটা পান ও সুপারি। এছাড়া আরও কিছু জিনিস প্রয়োজন হতেই পারে, তা অবশ্য নির্ভর করবে পুরোহিতের উপর। তাই কালীপুজোর বাজার করার ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ নিন। ভোগ নিজের পছন্দ মতো তৈরি করতে পারেন। তবে তা নিরামিষ হওয়াই ভালো।
আরও শুনুন: রক্তজবা ছাড়া হয় না কালীপুজো, দেবীর পায়ে আর কোন কোন ফুল দেওয়া যায়?
এবার আসা যাক পুজোর প্রসঙ্গে। মূল কাজ অবশ্যই পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ এসে করবেন। অন্যান্য পুজোর ক্ষেত্রে ঘট বসানো বা তিরকাঠি ঘেরার কাজ নিজেরাই করে নেওয়া যায়, কিন্তু কালীপুজোয় তেমনটা না করেই ভালো। বিশেষ করে ঘট স্থাপনের সময় কালী যন্ত্রম বা আসন আঁকা আবশ্যক। সেইসঙ্গে এই প্রতিটি ধাপের আলাদা আলাদা মন্ত্র রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে, এই পুজো যেন রাত্রি বেলায় করা হয়। অমাবস্যা তিথি যতই দিনের আলোয় শুরু হোক, শ্যামাপুজো নিশিকালীন। তাই রাত ১২টার পরই পুজো শুরুর নিয়ম। চাইলে তার আগে থেকে মূর্তিতে মালা দিয়ে সাজিয়ে রাখতে পারেন। জবা দেবীর প্রিয় ফুল। এছাড়া রজনীগন্ধা, গোলাপ, রক্তকরবী, গাঁদা এইসব ফুলের মালাও দেবীকে পরানো যেতে পারে। একইসঙ্গে মহাদেবের গলাতেও বেলপাতা এবং আকন্দর মালা দিতে ভুলবেন না। মন্ত্রের ক্ষেত্রেও ভরসা সেই পুরোহিত। আগেই বলেছি কালীপুজো ঘরে করলেও, নিজে হাতে না করাই শ্রেয়। তাই যে কোনও অবস্থায় দেবীর ধ্যান মন্ত্র উচ্চারণ করাও উচিত নয়। চাইলে কালীর প্রণাম মন্ত্রটি স্তব করতে পারেন। যা খানিকটা এরকম,
জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রা কালী কপালিনী দূর্গা শিবা সমাধ্যার্তী সাহা সুধা নমস্তুতে
তবে যে কোনও পুজোর ক্ষেত্রেই যা প্রয়োজন তা হল মনের ভক্তি। বাড়িতে পুজো করতে যেমন সমস্যা নেই, তেমনই সামর্থ্য না থাকলে মন্দিরে গিয়েও দেবীর আরাধনা করা যেতে পারে। অনেকেই এই পুজোয় উপোস করে থাকেন সারাদিন। এমনটা করতে পারলে অবশ্যই ফল মিলবে। তবে না করলেও সমস্যা নেই। ভক্তি মনে মা কে ডাকলেই তিনি সাড়া দেবেন।