শাস্ত্রজ্ঞান না থাকলে ঈশ্বরের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় না। আবার কেবল শাস্ত্র নিয়ে বসে থাকলে ওই বসে থাকাই সার হয়। কাজের কাজ কিছু হয় না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাই বলেন, ডুব দিতে। দরকার হলে হলুদ মেখে ডুব দাও। তা এই হলুদ মাখার তাৎপর্য কী? কী বলতে চাইতেন ঠাকুর? আসুন শুনে নিই।
হাজরা মহাশয় ছিলেন ঠাকুরের এক ভক্ত। তাঁর যৌবনকাল থেকেই বৈরাগ্যের ভাব — কোথায় সাধু, কোথায় ভক্ত, খুঁজিয়া বেড়ান। যখন দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে প্রথম আসেন ও সেখানে থাকতে চান ঠাকুর তাঁর ভক্তিভাব দেখিয়া ও দেশের পরিচিত বলিয়া, ওখানে যত্ন করিয়া নিজের কাছে রাখেন।
হাজরার জ্ঞানীর ভাব। ঠাকুরের ভক্তিভাব ও ছোকরাদের জন্য ব্যাকুলতা পছন্দ করেন না। মাঝে মাঝে তাঁকে মহাপুরুষ বলে মনে করেন। আবার কখনও সামান্য বলে জ্ঞান করেন।
একদিন তিনি ঠাকুরের ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায় আসন করেছেন। সেইখানেই মালা নিয়ে অনেক জপ করেন। রাখাল প্রভৃতি ভক্তেরা বেশি জপ করেন না বলে লোকের কাছে নিন্দা করেন।
তিনি আচারের বড় পক্ষপাতী। আচার আচার করিয়া তাঁহার একপ্রকার শুচিবাই আছে।
এই হাজরা মহাশয়কে ঠাকুর একবার বললেন, তুমি যা করছ তা ঠিক, — কিন্তু ঠিক ঠিক বসছে না। কারু নিন্দা করো না — পোকাটিরও না। তুমি নিজেই তো বল, লোমস মুনির কথা। যেমন ভক্তি প্রার্থনা করবে তেমনি ওটাও বলবে — ‘যেন কারু নিন্দা না করি’।”
হাজরা মহাশয় জানতে চাইলেন, প্রার্থনা করলে তিনি শুনবেন?
ঠাকুর বললেন, এক — শো — বার! যদি ঠিক হয় — যদি আন্তরিক হয়। বিষয়ী লোক যেমন ছেলে কি স্ত্রীর জন্য কাঁদে সেরূপ ঈশ্বরের জন্য কই কাঁদে?
আরও শুনুন: ধনরত্নের বিনিময়ে কি মেলে ভগবানের ভালবাসা?
এবার ঠাকুর কামারপুকুরের একটা ঘটনার নমুনা টেনে বললেন, “ও-দেশে একজনের পরিবারে অসুখ হয়েছিল। সারবে না মনে করে লোকটা থর থর করে কাঁপতে লাগলো — অজ্ঞান হয় আর কি!
“এরূপ ঈশ্বরের জন্য কে হচ্ছে!”
হাজরা মহাশয় ঠাকুরের পায়ের ধুলা নিচ্ছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, “উগুনো কি?”
হাজরা উত্তর দিলেন, যাঁর কাছে আমি রয়েছি তাঁর পায়ের ধুলা লব না? শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, ঈশ্বরকে তুষ্ট কর, সকলেই তুষ্ট হবে। তস্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্। ঠাকুর যখন দ্রৌপদীর হাঁড়ির শাক খেয়ে বললেন, আমি তৃপ্ত হয়েছি, তখন জগৎসুদ্ধ জীব তৃপ্ত — হেউ-ঢেউ হয়েছিল! কই মুনিরা খেলে কি জগৎ তুষ্ট হয়েছিল — হেউ-ঢেউ হয়েছিল?
আরও শুনুন: স্বর্গের সিংহাসন পেয়েও কেন পতন হয়েছিল রাজা নহুষের?
ঠাকুর তাই বলেন, জ্ঞানলাভের পরও লোকশিক্ষার জন্যে পূজাদি কর্ম রাখে। বলেন, “আমি কালীঘরে যাই, আবার ঘরের এই সব পট নমস্কার করি; তাই সকলে করে। তারপর অভ্যাস হয়ে গেলে যদি না করে তাহলে মন হুস্ফুস্ করবে। বটতলায় সন্ন্যাসীকে দেখলাম। যে আসনে গুরুপাদুকা রেখেছে তারই উপরে শালগ্রামও রেখেছে! ও পূজা করছে! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যদি এতদূর জ্ঞান হয়ে থাকে তবে পূজা করা কেন? সন্ন্যাসী বললে, — সবই করা যাচ্ছে — এ ও একটা করলাম। কখনও ফুলটা এ-পায়ে দিলাম; আবার কখনও একটা ফুল ও-পায়ে দিলাম।’
বাকি অংশ শুনে নিন।