চন্দ্রাদেবী যখন পরলোকগমন করলেন, তখন ঘটল এক ঘটনা। গৃহস্থের মতোই ঠাকুর জলে নেমে অঞ্জলি ভরে জল তুললেন। কিন্তু যতবার জল তুলছেন, ততবার জল আঙুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই আর বদ্ধ-অঞ্জলিতে জল ধরে রেখে তর্পণ করতে পারছেন না।
সন্ন্যাস এবং সংসারকে যে এক আশ্চর্য সমন্বয়ে বেঁধেছিলেন ঠাকুর, সে তো আমরা জেনেইছি। মা সারদামণির সঙ্গে দিব্য দাম্পত্যের যে নমুনা তিনি তুলে ধরেছিলেন, তার তুলনা জগতে মেলে না। সেকালের নিরিখে নারীপ্রগতির ভাবনাকে ঠাকুর যে কতখানি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা আমরা আজ এই সময়ে দাঁড়িয়েও বুঝতে পারি। একই সঙ্গে ঠাকুর একটা নতুন পথেরও সন্ধান দিয়েছিলেন। বলা যায়, নিজের জন্য তিনি নিজের পথ আবিষ্কার করেছিলেন। আমাদের নিশ্চিতই মনে পড়বে যে নরেন্দ্রনাথও একসময় একটা নতুন পথের সন্ধানে ছিলেন। ব্রাহ্মধর্মের আদর্শের সঙ্গে তিনি সহমত হয়েও, প্রতিদিনের অনুষ্ঠান ইত্যাদি মন থেকে তেমন মেনে নিতে পারেননি। একই ছায়া দেখা যায় তাঁর গুরু অর্থাৎ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৭): দিব্য দাম্পত্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ দূর করলেন ঠাকুর
তিনি সন্ন্যাস-দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তোতাপুরীর কাছে। সে সময় তাঁর মা চন্দ্রাদেবী ঠাকুরের কাছেই ছিলেন। ছেলেকে সন্ন্যাস নিতে দেখলে মা কষ্ট পাবেন, এই ভাবনা ঠাকুরের মনে বেশ দাগ কেটেছিল। এর আগে দুই পুত্র এবং পত্রবধূকে হারিয়েছেন তিনি। জীবনের এই বিপর্যয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন ঠাকুরের মা। তাই তিনি ঠিক করেছিলেন জীবনের শেষ কটা দিন গদাধরের কাছে থেকেই কাটিয়ে দেবেন। তিনি দক্ষিণেশ্বরে এলে মথুরবাবু তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সসম্মানে। সামান্য যেটুকু প্রয়োজন তাঁর, তা নির্বাহের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দায়িত্ববান পুত্রের মতো ঠাকুরও মায়ের সুখ-স্বাচ্ছন্দের দিকে নজর রাখতেন। এর কিছুদিন পরেই সেখানে আসেন তোতাপুরী। এবার ঠাকুর যখন সন্ন্যাস-দীক্ষা নেবেন মনস্থ করলেন, তখন মায়ের সামনে তা নিতে পারলেন না। তিনি দীক্ষা নিলেন, তবে গোপনে। এর ফলেই যেন ঠাকুর আজীবন বাইরে গৃহস্থ আর অন্তরে সন্ন্যাসী থাকে এগেলেন।
আরও শুনুন: শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৬): সংসার আর সন্ন্যাসকে আশ্চর্য সমন্বয়ে বেঁধেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
এরপর চন্দ্রাদেবী যখন পরলোকগমন করলেন, তখন ঘটল এক ঘটনা। গৃহস্থের মতোই ঠাকুর জলে নেমে অঞ্জলি ভরে জল তুললেন। কিন্তু যতবার জল তুলছেন, ততবার জল আঙুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই আর বদ্ধ-অঞ্জলিতে জল ধরে রেখে তর্পণ করতে পারছেন না। পারবেন কী করে! তিনি যে সন্ন্যাসী। আর সন্ন্যাসীদের মৃত পূর্বপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করতে নেই। এই হল সন্ন্যাসী আর গৃহস্থের সমন্বয়। ঠাকুর যেন সন্ন্যাসী হয়ে গৃহস্থের ভূমিকায় অভিনয়ই করে গিয়েছেন। অর্থ তিনি স্পর্শ করতে পারতেন না। পরিহাস ছলেও মিথ্যা উচ্চারণ করতে পারতেন না। রমণীর মধ্যে, এমনকী পতিতা রমণীর মধ্যেও তিনি মা কালীকেই দর্শন করতেন। একজন সন্ন্যাসীর মতোই উঁচু তারে বাঁধা ছিল তাঁর মন। অথচ তিনি থাকতেন একেবারে ছাপোষা গৃহস্থের মতোন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ২৫): ঠাকুরকে ঈশ্বরের অবতার হিসাবে চিনেছিলেন ভৈরবী মা
এই পথ ঠাকুর যেন নিজেই নিজের জন্য খুঁজে বের করেছিলেন। যে কারণে একজন সন্ন্যাসীর কাছে পারিবারিক সমস্ত বন্ধন কাটানো জরুরি, সেই আধ্যাত্মিক স্তরে তিনি নিজেকে উন্নীত করেছিলেন। ফলে এই বন্ধন থাকার প্রভাব পড়েনি তাঁর উপর। তা ছাড়া ঠাকুর নিত্য ও লীলা – এ দুয়ের মধ্যে প্রভেদ করেননি। এটাও সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। ঠাকুর দুয়ের মধ্যেই ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
আর সবার উপরে ছিল তাঁর করুণা। তিনি করুণাঘন মহাপুরুষ। করুণার অবতার ছিলেন শ্রীচৈতন্য এবং গৌতম বুদ্ধও। জগতকে করুণাদান তাঁরা করেছিলেন, তবে সন্ন্যাসীর পথ ধরেই। পরিজনদের সঙ্গে তাঁরাও সদয় ব্যবহারই করেছিলেন। কিন্তু ঠাকুর যেভাবে সংসারী সেজে ছিলেন, তেমনটি আর করেননি। আসলে ঠাকুর বোধহয় জগতে প্রেমের একটি অন্য অর্থ প্রতিভাত করতে চাইছিলেন। যে প্রেম অন্তরে বিরাজ করলে আত্মপর বলে আর কিছু থাকে না। সেই করুণার মূর্তি হয়েই যেন তিনি হাজির হয়েছিলেন। আর তাই তো শিষ্য নরেন্দ্রনাথকে দিয়ে গিয়েছিলেন যুগের দিক্ষামন্ত্র- জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।