ছোটবেলার ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে অনেকদিন। রিটার্ন টিকিট নেই। স্মৃতির গায়ে তবু ফেরার ডাক। সেইসব জমানো চিঠিতেই শোনো-র ডাকঘর। পড়ে-শুনে নিন।
স্নেহের ছোটবেলা,
ভেবেছ, আমায় ছেড়ে পালাবে! সেটি হচ্ছে না। কারণ আমি চাইলেই তোমায় ঠিক দেখতে পাই। দুপুরবেলা একলা শুয়ে দিব্যি ভাবতে পারি। আরে বাবা, চোখের সামনেই দেখতে পাব, তার তো মানে নেই।
তোমায় ছেড়ে এসেছি অনেকদিনই হল, বলো! তবে কষ্ট হয় এটা ভেবে যে, তোমার সঙ্গে কোনোদিন, আর কোনও দিনই দেখা হবে না। বয়সের ভারে আজ চোখে চশমা, হাঁটুতে কড় কড় শব্দ। কিন্তু জানো, চুপচাপ থাকলে বা শারীরিক উপদ্রবে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। রাগও হয় নিজের অক্ষমতায়। ভাবি, তোমার মতো বয়সে কতই তো দাপিয়ে বেড়িয়েছি। সাইকেলে চেপে কোথায় কোথায় না গেছি! কোচিং সেন্টার, স্কুল, বন্ধুদের বাড়ি। সাইকেল ছিল আমার জীবনের সঙ্গে একেবারে সাত পাঁকে বাঁধা। জানো, সেই হারকিউলিস সাইকেলটা এখনও আমি চড়ি। ওর পিঠে চাপলে আমি তোমাকে পেয়ে যাই। সেই বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের পাতা ওল্টালে আমি ইন্দুবাবুর ক্লাসে পৌঁছে যাই। ভয় হয়, পড়া বলতে পারব তো! না হলে যে কানমলা খেতে হবে, ওরে বাবা! ঠিক মনে পড়ে যায় তোমার কথা। স্মৃতির ঢেউগুলো ভাসতে ভাসতে চলে আসে আমার দুয়ারে। খেলার মাঠ, স্কুল, আমার ভাই, মা, বাবা, সবকিছু…।
স্কুলব্যাগটা কোনোমতে ঘরে রেখেই এক ছুটে মাঠে! মনিন্দর সিংকে দেখেই তো প্রথম প্রেরণা, বাঁ-হাতে স্পিন বোলিং করা। তারপর একটু জোরে বল করা, তা-ও। চোখে কিছুটা হলেও কি একজন খেলোয়াড় হবার স্বপ্ন ছিল না! হয়তো তাই নেশা ধরে গিয়েছিল; মাঠে কখন দিনের সেরা পারফরম্যান্সটা দেখাব! হাসি পাচ্ছে? ভাবছ, এখন নিজেই কুপোকাৎ! সে তো হবারই ছিল। বয়স তো আর বসে থাকে না। সময়ের কাছে কেউই আপন হয় না। তবে খুব মন চায় তোমার কাছে পৌঁছে যাই। যদি একবারের জন্য হলেও আমার ভাইটাকে দেখতাম, যে ইলেভেনে উঠেই অকালে চলে গেল! বিরাট কিছু হবার স্বপ্ন তো আমি দেখিইনি। যেটা মনে হয়েছে শুধু তা-ই করে গেছি। আর আজ দিন কাটে অফিসের ফাইল, ফোন আর কম্পিউটার নিয়ে। ব্যাগ রেখে খেলার মাঠে দৌড়ে যাবার কোনও ব্যস্ততা নেই। চালতাগাছের পাশের পুকুরটায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো নেই। কাঠগোলাপ গাছে উঠতে গিয়ে কাঠপিঁপড়ের কামড় খাওয়ারও ভয় নেই। ইচ্ছের চোখ ঢেকে গেছে ফ্ল্যাটের জঙ্গলে। খেলার মাঠটাই যে আর নেই! ওই ফ্ল্যাট থেকে যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে স্কুলবাসের জন্য, যখন দারোয়ান গেট খুলে দেয় গাড়ি বেরোনোর সময়, আমি ক্যামন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। ইস, তোমায় ফেলে আমি কত দূরে চলে এলাম!
লোডশেডিং হলে ঠাকুমার দেওয়া পাখার বাতাস, গায়ের ওপর মায়ের হাত বুলিয়ে দেওয়া, থই থই জলে ভিজে ভিজে পুঁটি মাছ ধরা, মায়ের সঙ্গে দোতলা বাসে চেপে বাবার অফিসে যাওয়া, বিকেলবেলায় চপ মুড়ি খেতে খেতে বন্ধুদের সঙ্গে ফক্কুরি করা– এসব এখন তোমার কাছেই জমা থাক।
শুভেচ্ছা রইল।