মন্দিরের প্রধান পূজারী হলেন গদাধর। সে বছরই তাঁর দাদা পরলোক গমন করেন। তরুণ পূজারী কিন্তু প্রথাগত পূজাপদ্ধতি অনুসরণ করলেন না। পাথরের দেবতা নয়, তিন অনুসন্ধানে রত চিন্ময়ী দেবতার। গদাধর বিশ্বাস করতেন রামপ্রসাদের মতো ভক্তেরা সত্যি মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন। তাহলে তিনি পাবেন না কেন?
ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এবং নরেন্দ্রনাথ – গুরুশিষ্যের জীবনকে আমরা যত মিলিয়ে মিলিয়ে দেখি, তত বিস্মিত হই। কেন যে নরেন্দ্রনাথকেই শ্রেষ্ঠ আধার হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন ঠাকুর, তা যেন খানিক খানিক বোঝা যায়। বলা যায়, ঠাকুর নিজে যে পথে, যেভাবে সাধনমার্গে এগিয়েছিলেন, তারই ছায়া যেন দেখেছিলেন নরেন্দ্রনাথের মধ্যে। আমরা আগেই শুনেছি যে বাঁধাধরা কোনও কিছুর প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল না। ছোটবেলা থেকেই তিনি এটা ওটা নিয়ম ভাঙতে ভাঙতেই এগিয়েছিলেন। আবার সত্যিই কি প্রথাগত কোনও কিছুতেই তাঁর বিশ্বাস ছিল না! না, তা কিন্তু নয়। এইখানেই ঠাকুর এবং নরেন্দ্রনাথের মধ্যে একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। প্রথম জীবনে দুজনেই নিজের বিশ্বাসকে যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁরা। নরেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে আমরা এর একাধিক উদাহরণ দেখেছি। স্বয়ং ঠাকুরও তো এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৮): কেন টোলের পড়াশোনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন গদাধর?
উপনয়নের পর থেকেই বালক গদাধর পূজার্চনা করতে খুব ভালবাসতেন। জগদীশ্বরের পূজায় তিনি তন্ময় হয়ে থাকতেন। সেই গদাধর যখন একটু বড় হয়ে কলকাতায় এলেন, তখন একটা গোল বাধল। সেটা ১৮৫৫ সাল। রানি রাসমণির নবনির্মিত কালীমন্দিরে পূজারীর দায়িত্ব নিয়েছেন গদাধরের দাদা রামকুমার। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তিনি ভাইকে মন্দিরে এনেছেন। কিন্তু মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী উচ্চকুলজাত ছিলেন না। নিজের ভিতরে থাকা সংস্কার সেদিন আহত করছিল তরুণ পূজারী গদাধরকে। তিনি দাদার কথা ফেলতে না পেরে এলেন বটে, থাকলেনও। কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত তিনি মন্দিরের বাইরে গঙ্গাতীরে নিজের হাতে রান্না করে খেতেন। প্রাচীন কিছু সংস্কার বা দেশে বহাল থাকা যে জাতিবিচার তা থেকে তরুণ গদাধর পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন না। আর গদাধর যা বিশ্বাস করতেন, তা থেকে সহজে সরতেন না। এতটাই ছিল তাঁর সে বিশ্বাসের জোর যে, দাদার চাকরি, অন্নসংস্থান ইত্যাদি বিষয় মাথার উপর থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের বিশ্বাস জলাঞ্জলি দেননি। বরং নিজের মতো করে নিজের বিশ্বাসে থিতু থাকার ব্যবস্থাই করে নিয়েছিলেন।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৭): ঠাকুরের বাল্যজীবনেই ঘটেছিল কিছু অদ্ভুত ঘটনা
বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেই মন্দিরের প্রধান পূজারী হলেন গদাধর। সে বছরই তাঁর দাদা পরলোক গমন করেন। তরুণ পূজারী কিন্তু প্রথাগত পূজাপদ্ধতি অনুসরণ করলেন না। পাথরের দেবতা নয়, তিন অনুসন্ধানে রত চিন্ময়ী দেবতার। গদাধর বিশ্বাস করতেন রামপ্রসাদের মতো ভক্তেরা সত্যি মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন। তাহলে তিনি পাবেন না কেন? এই ভাবনাতেই আকুল হয়ে থাকতেন তরুণ গদাধর। আর সেই ছাপ পড়ল তাঁর পুজোতেও। নিত্যবিধি মেনে যা যা কর্ম করার তা তিনি করতেন ঠিকই। কিন্তু শুধু তাতেই তাঁর মন ভরে না। তিনি বুঝতে পারেন, মায়ার পর্দাখান যেন তাঁর চোখের সামনে ঝুলে রয়েছে। তাই সামনে থাকলেও তিনি ঈশ্বরকে দর্শন করতে পারছেন। ঈশ্বরদর্শনের জন্য তখন তাঁর প্রায় উন্মাদ দশা। শরীরবোধ লুপ্ত হয়েছে। কতখানি সে আকুলতা একটা ঘটনাতে তা আমরা কিছুটা অন্তত বুঝতে পারব। মন্দিরের একপাশে ছিল এক কবরখানা। সেখানে দিনের বেলাতেও কেউ যেত না। তরুণ পূজারী গদাধর রাতের বেলা সেই কবরখানার একটা আমলকী গাছের নিচে বসে ধ্যান করতেন। কোনও বন্ধন রাখতেন না শরীরে। না একখানি সুতো, এমনকী উপবীতও নয়। এই যে ঈশ্বর দর্শন পাবার আকুলতা – এ যে ঠিক নির্দিষ্ট প্রথা মেনে হচ্ছে তা নয়। অন্তরের ভিতর যে ভাবতরঙ্গের ঢেউ উঠছে, তার বশেই আকুল হয়ে ছুটে চলেছেন গদাধর। তাঁর আশেপাশের লোক যেন তাকে চিনতেই পারেন না। আবার তাঁর কষ্টও চোখে দেখতে পারেন না। এই কঠোর সাধনার ফল মিলল। একদিন হল দিব্যদর্শন। পরমানন্দের সাগরে ভেসে গেলেন ঠাকুর। খসে পড়ল মায়ার পর্দা। পাষাণের দেবতা নয় চিন্ময়ী মা-কে অনুভব করলেন তিনি।
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৬): ঠাকুর চোরকে বলেন চুরি করতে, গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে!
ঠাকুর নিজে পরে সেই দিব্যদর্শনের অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘জলশূন্য করবার জন্য লোকে যেমন সজোরে গামছা নেঙড়ায়, মনে হল হৃদয়টাকে ধরে কে যেন সেরকম করছে! মার দেখা বোধহয় আর কোনওকালেই পাব না ভেবে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। অস্থির হয়ে ভাবলাম আর এ জীবনে আবশ্যক নেই। মার ঘরে যে অসি ছিল দৃষ্টি সহসা তার উপর পড়ল। এই দণ্ডেই জীবনের অবসান করব ভেবে উন্মত্তের মতো ছুটে সেটা ধরতে যাচ্ছি, এমন সময় … ঘর, দ্বার, মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হয়ে গেল – কোথাও যেন আর কিছু নেই! আর দেখছি কি – এক অসীম অনন্ত চেতনা জ্যোতিঃসমুদ্র – যেদিকে যতদূর হতে তার উজ্জ্বল ঊর্মিমালা তর্জন গর্জন করে গ্রাস করবার জন্য মহাবেগে অগ্রসর হচ্ছে! দেখতে দেখতে সেগুল আমার উপর আছড়ে পড়ল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলিয়ে দিলে! হাঁপিয়ে হাবুডুবু খেয়ে সংজ্ঞাশূন্য হয়ে পড়ে গেলাম। তারপর বাইরে যে কি হয়েছে, সেদিন ও তার পরদিন যে গেছে, তার কিছুই জানতে পারিনি। অন্তরে কিন্তু একটা অননুভূতপূর্ব জমাট-বাঁধা আনন্দের স্রোত প্রবাহিত ছিল এবং মার সাক্ষাৎ প্রকাশ উপলব্ধি করেছিলাম।’
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৫): উপনয়নের সময়ই সংস্কারের বেড়া ভেঙেছিলেন বালক গদাধর
ঠিক এইখানে এসেই কি আমাদের মনে পড়ে না সেই সেদিনের ঘটনা। যেদিন নরেন্দ্রনাথের কোলে ডান পা-খানা তুলে দিয়েছিলেন ঠাকুর। আর নরেন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, সমস্ত ঘরটা, ঘরের দেওয়ালগুলো প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে মহাশূন্যে লীন হয়ে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে তাঁর ভিতরের যে আমিত্ব তাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হাহাকার করে উঠেছিলেন নরেন্দ্রনাথ!
আরও শুনুন – শ্রীরামকৃষ্ণের দাস (পর্ব ১৪): অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বুঝলেন নরেন্দ্রনাথ
গুরু-শিষ্যের জীবনের পাতা এইভাবে বারবার এসে মিলেছে এক বিন্দুতে। আমরা সেই সাদৃশ্য যত দেখি, বিস্মিত হই। বুঝতে পারি, মহাকালের এক অসামান্য লীলার সূত্রেই তাঁরা দুজন এসেছিলেন এ ধরাধামে।