চেনা বাহনে সফর তো অনেক হল। মর্তে এসে দুর্গাও এবার আম-মানবী। অতএব ভরসা গণপরিবহণেই। আর সেই ভিন-সফরের গল্পই হাজির সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র ‘আঃ! বাহন‘ পর্বে। ট্রেন দুর্ঘটনার লাগাতার খবর দেখে আতঙ্কে গণেশ। অথচ ট্রেনে চড়েই মর্তে আগমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মা দুগ্গা। কেমন হবে সে যাত্রা, ঘুরে দেখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।। অলংকরণে দীপঙ্কর ভৌমিক।
গণেশ এবার উৎসবে ফিরছে না।
মাকে সে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে সে কথা। দুর্গা অবশ্য শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন। বচ্ছরকার দিনে একবার মা-বাবার কাছে যাওয়ার অনুমতিটুকু মেলে। একবার ছেলেমেয়ে সকলকে সঙ্গে করে ভরা সংসারের ছবিটুকু জাগিয়ে দিয়ে আসেন বুড়ো মানুষ দুটোর মনে। বাকি যা কিছু হেনস্তার কথা, আর পাঁচটা বিয়ে-হয়ে-যাওয়া মেয়ের মতোই সেসব ঢাকাচাপা দিয়ে রেখে যান বরফে। তাজা থাকে। কিন্তু এই গোটা চারেক দিন তাঁর খোলা হাওয়া। গেরস্থের সংসার, এইটুকু হাওয়ার দাম দিতেই সারাবছর ধরে সাশ্রয় করতে হয় শিবের গিন্নিকে। তারপর নন্দীকে তুতিয়েপাতিয়ে টিকিট জোগাড় করা। এতদিনের চেনা লোক হলে কী হবে, দালালি নিয়ে তবে টিকিটের দাম হিসেব করে। কিন্তু দুর্গাই বা কী করবেন! রেল কোম্পানির আজকাল যা গুমর বেড়েছে, মাস চারেক আগে রিজার্ভেশনের উইন্ডো খুলতে না খুলতেই দেখা যায় টিকিট শেষ। টিকিট পেতে গেলে বোধহয় এবার এক বছর আগে থেকে ধরনা দিতে হবে। যা হাল হচ্ছে গোটা দেশটার, ধরনা না দিলে কেউ তো কোনও কথাই শুনতে চায় না। তা সে যাক, এত ঝঞ্ঝাট পুইয়ে এত খরচ করে জোগাড় করা টিকিট, আর এখন ছোট ছেলেই কিনা বেঁকে বসল!
এদিকে হাতে আর বেশি সময় নেই। কেবল টিকিট জোগাড় করলেই তো হল না, ট্রেনে উঠতেও কতখানি পথ উজিয়ে যেতে হবে। আজ অব্দি তো কৈলাস পর্যন্ত রেললাইন পাতার কাজটাই শেষ হল না। প্রতি বছর দুর্গা আশায় আশায় থাকেন, এইবার দুয়ারে রেল এল বলে! অথচ সব প্রতিশ্রুতিই কেমন বানভাসি। দুর্গা খবরের কাগজ ঘুরে-টুরে দেখেছেন, রেলওয়ের মোটামুটি ৮৪০খানা প্রোজেক্ট নাকি আপাতত লেটে রান করছে। কোনোটা শেষ হতে আরও বছর ষোল সময় লাগবে, তো কোনোটা আবার চলে গিয়েছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। একমাত্র লেট করাতেই ভারতীয় রেল ধারাবাহিকভাবে সফল, সুতরাং মা দুগ্গাকেই পাঁজিপুথির অঙ্ক কষে সময় হাতে রেখে বেরোতে হয়। এর মধ্যে গণেশের এহেন বায়নাক্কা শুনে দুর্গা আর রাগ সামলাতে পারলেন না।
তবে দুর্গা জানেন, এ বড় কঠিন ঠাঁই। হাতিমাথা আর বড়সড় শরীর নিয়ে ছেলেটা তাড়াহুড়ো করতে পারে না যেমন, তেমনই তার মতও চট করে নড়েচড়ে না। ধমকধামকেও তার মুখে একই রা, ট্রেনযাত্রায় শামিল হতে সে একান্তই নারাজ। তবে কি ভয় পাচ্ছে? আচমকাই মা দুর্গার মনে এল, ইদানীং কালে পরপর ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের খবর শোনা যাচ্ছে বটে। আর দিনদুনিয়ায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেসব খবর গণেশও দিব্যি রাখে। এই তো, ক’দিন আগেই ছড়িয়েছিটিয়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের কতগুলো বগি। মাত্র ছ’বছরের শিশুর আর অধিকার রইল না এ পৃথিবীতে, স্ত্রীর সঙ্গে আগের রাতে গানের আসর বসানোর পর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ‘নেই’ হয়ে গেলেন তাঁর স্বামী, কিংবা চাকরিতে যোগ দিতে আসার পথেই ডিউটিতে দাঁড়ি পড়ল যুবকের। তবে এ তো নতুন কথা নয়। হিসেব বলছে, শুধু ২০২৩ সালেই সাড়ে তিনশোর বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন রেল দুর্ঘটনায়। আর এই দুর্ঘটনার ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। তারপরেও কারই বা টনক নড়ছে! রেল কোম্পানির যে দেরি নিয়ে এতক্ষণ গজগজ করছিলেন, সেই দেরি সেখানেও দাঁড়িয়ে আছে জগদ্দল পাথরের মতোই। দুর্ঘটনা রোখার জন্য মাঝে মাঝেই এলএইচবি রেল বগি, কবচ প্রযুক্তি, আরও কী কী কথা ওঠে… খবরে পড়েছেন বটে। এও পড়েছেন, রেল যে গতিতে কাজ করছে, তাতে গোটা দেশের সব লাইনে কবচ বসাতেই সময় লাগবে নাকি গুনে গুনে ২২৭টি বছর! আজকাল যে লোকগুলো ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে ট্রেনে ওঠে, তাদের দিকে তাকিয়ে দুর্গারও কোনও এক দশভুজাকে ডাকতে বড় ইচ্ছে করে।
মনে মনে এত কিছু ভাবতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন কোথায়। সংবিৎ ফিরল আবছা গুঞ্জন কানে আসায়। তাকিয়ে দেখেন, গণেশের পাশে বাহনগুলো কখন যেন এসে ভিড় জমিয়েছে। এমনকি বুড়ো সিংহটাও তাদের দলে। গণেশের মতোই তারা কেউই নাকি এবার উৎসবে যাবে না, সেই মর্মেই ডেপুটেশন দিতে এসেছে। দুর্গা মনে মনে হাসলেন। আন্দোলনের হুজুগে পড়েছে সবকটা! রাজনীতির ঘাঁতঘোঁত তিনি দিব্যি জানেন। নেতাকে সামলে নিতে পারলেই যে ওসব আন্দোলন হাওয়া হয়ে যাবে, তাও জানেন। নরম গলায় ছেলেকে বোঝাতে গেলেন দুর্গা। যেভাবে সবকিছুই বেসরকারিকরণের ধুম উঠেছে, তাতে সরকারি রেলকে টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। আর সেই রেলের ম্যাসকটও কিনা হাতি। তাহলে গণেশের তো রেলে চড়ার একটা নৈতিক দায়িত্বও বর্তায়, নাকি?
সেই হাতিকেই নিত্যদিন এই ট্রেনের চাকায় কাটা পড়তে হয়, সে কথা কি তুমি জানো না মা?
গণেশের এই উত্তরটা আশা করেননি একেবারেই। এরপরেও অবশ্য থামেনি, সে বলে চলেছিল, রেললাইন যে নানাভাবেই হত্যাকে স্বাভাবিক করে তুলতে তুলতে এগিয়েছে, সে ইতিহাস যেন আমাদের জেনেও না-জানা। কিন্তু মানুষের এই উন্নয়নের দায় সবচেয়ে বেশি করে পোহাতে হয়েছে আমাদের- বন আর বন্যপ্রাণীদের। একদিকে পরিবেশবান্ধব যান বাঁচিয়ে রাখার কথা, অন্যদিকে সেই ইলেকট্রিক ট্রেন চালিয়ে যেতেই লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলার অনুমতি। লক্ষ লক্ষ প্রাণীদের বাস্তু হারানো। অন্ন কেড়ে নেওয়া। এ দুয়ের মাঝে মানুষ ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রইল? তার সব সহমর্মিতা আর অনুভব যে নিঃশব্দে খুন হয়ে গেল এই চক্রে, সে খোঁজ কেউ জানল কি?
দুর্গা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে গণেশ আবার বলল, প্রমাণ চাও? হৃদয়ের সব অনুভূতি মরে না গেলে অমন করে কি হাতিটাকে মেরে ফেলতে পারত ওরা? এই যে ঝাড়গ্রামের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়া সেই হাতি, যে তোমার মতোই একজন মা, জ্বলন্ত লোহার শিক ঢুকিয়ে তাকে কেন মেরে ফেলা হল? সেই সময়ের ছবিটা আমার চোখে কেবল ফিরে ফিরে আসে, যখন একটু একটু করে পিছনের পা দুমড়ে-মুচড়ে বসে পড়ছে সে, আর তার সঙ্গের ছোট্ট ছানাটা ভয়ে আতঙ্কে প্রাণপণ পালানোর চেষ্টা করছে, তখন জানো পাশ থেকে একটা কচি গলা বারবার বলছিল, ওর কষ্ট হচ্ছে।
কেউ শোনেনি।
কেউ শোনে না।
দুর্গা শুনছিলেন। শুনতে শুনতে তাঁর চোখে একটা অন্য ছবি ভেসে আসছিল। শুম্ভ-নিশুম্ভের সেই নোংরা প্রস্তাব। তাঁকে অঙ্কশায়িনী হওয়ার কথা বলা। তাদের লালসার লেলিহান শিখা থেকে সেদিন এমন করেই পালাতে চেয়েছিল সেদিনের সেই মেয়ে। যেমন করে আজও অনেক মেয়ে পালাতে চায়। যেমন করে আজও অনেক মেয়ে পালাতে পারে না। প্রকৃতি, প্রাণী, নারী- একটামাত্র বিপন্নতার সুতো কেমন সকলকেই বেঁধে ফেলেছে, দুর্গা এতদিনকার চেনা দৃষ্টিতে তা দেখতেই পাননি! সংসারের তেল-নুন-হলুদের আস্তরণ সরিয়ে আজ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল সেদিনের তীব্র রাগ আর ঘেন্না। সমস্ত অন্যায়ের সামনে প্রতিবাদে জেগে উঠল ত্রিনয়ন।
দুর্গা গণেশের হাত ধরলেন শক্ত করে। সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, পথে নামার ডাক এসেছে। আয়, পা মেলাই।
আরও পড়ুন: