বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। আর সে পুজোর সঙ্গে গভীর যোগ পেটপুজোর। কিন্তু বিদেশের রকমারি খাবার নয়, উৎসবের আবহে বাঙালিয়ানাতেই যদি ডুব দেওয়া যায়, কেমন হয় তাহলে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক দুর্গাপুজোর বনেদি খাবারের কথা।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
শোভাবাজার রাজবাড়ির ছেলে কেশবেন্দ্র দেবের বিয়ে। রাজবাড়ির ভোজ বলে কথা! বিয়েবাড়ির মেনুকার্ডে দেখা গেল গুনে গুনে ৩৬ রকম পদের বর্ণনা। পদ্মলুচি থেকে চন্দ্রকলা, মুগ মনোহর থেকে ক্ষীরের খড়ুই, বিপ্রভোগ থেকে সন্ধানিকা- সেসব খাবারের যেমন নাম তেমনই স্বাদ। ১৯০৬ সালে এই বিয়ের ভোজের কথা জানিয়েছেন সেকালের কলকাতার ইতিহাসকারেরা। তা যেখানে বিয়েবাড়িতে এমন ভোজের আয়োজন, বাড়ির বনেদি পুজোর ভোজ কি তা থেকে পিছিয়ে থাকবে? আদৌ নয়। কেবল শোভাবাজার রাজবাড়িই নয়, কলকাতার যে কোনও বনেদি বাড়িই পুজোর ভোগে, কিংবা বাড়ির অতিথি আপ্যায়নের জন্য এমন বনেদি খাবারদাবারের আয়োজনই করত সেকালে। এখন অবশ্য যুগ পালটেছে। ঘরের খাবারে আমাদের যেটুকু নজর, তার চেয়ে বেশি চোখ আটকায় দেশবিদেশের রকমারি খাদ্যতালিকায়। বাঙালির আজকের বুলি ‘চাই নিজ খাদ্য’ নয়, চাইনিজ থেকে থাই থেকে কোরিয়ান- সে আজ বিশ্বনাগরিক। কিন্তু নানা রাজ্যের, নানা দেশের খাবার তো বছরভর খেয়েই থাকেন। তার বদলে, বাংলার পুজোয় যদি পুজোর খাবারেও জুড়ে থাকে বাঙালিয়ানা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক তেমনই কিছু খাবারের কথা। যা সেকালেও ভোজের সাজ বাড়িয়ে দিত, আবার একালেও জিভের স্বাদ পালটে দিতে পারে অনায়াসেই।
আরও শুনুন:
সংখ্যায় অসংখ্য পুজোসংখ্যা, রামের অকালবোধনে রাবণই হবেন পাঠক!
প্রথমে ধরুন ঘি-ভাতের কথা। পুজোর ভোগ হিসেবে খুবই প্রচলিত ছিল অথচ এখন আর নানা কারণে হয় না, এমন কয়েকটি পদের নাম করতে বললে প্রথমেই বলতে হয় সাদা ধবধবে ঘি-ভাতের কথা। ঘি-ভাত মানে কিন্তু পোলাও নয় মোটেই। ভুরভুরে গন্ধওয়ালা পুরনো গোবিন্দভোগ চালকে, গরুর দুধের সর-তুলে বানানো ঘিয়ের সঙ্গে সামান্য নেড়েচেড়ে ঘি-ভাত তৈরি করা হত। থাকত আমআদা দিয়ে সোনামুগের ডাল। আর বেগুন বাসন্তীর কথা শুনলে তো মনে মনে পুরনো দিনে ফিরে যাবেন অনেক বাঙালিই। লম্বা করে কাটা ল্যাজওয়ালা বেগুনের ওপর ঝাল-ঝাল সাদা সরষে এবং মিষ্টি-মিষ্টি নারকেল কোরার পরত মাখানো, এই হল বেগুন বাসন্তী। নারকেল কোরা দিয়ে পানিকচুর লতি কিংবা মোচার ঘণ্ট- সেও কি কম লোভনীয়? শুধু তাই নয়, থাকত এঁচোড়ের কোপ্তা এবং ডুমুরের কোপ্তা। সেকালে তিন ধরনের ডালনা মা দুর্গার জন্য ঘুরেফিরে রান্না করা হত। পেঁপের ডালনা, আলু-কাঁচকলা-পটলের হলুদ ছাড়া সাদা ডালনা আর ছানার ডালনা। টাটকা গরুর দুধকে পাতিলেবু দিয়ে ছানা কাটিয়ে, ভাল ঘিয়ে তা দিয়ে গোল গোল বড়া ভেজে ফেলে, তবে তৈরি হত ছানার ডালনা। কোনও সাবেক বাড়ির ভোগে এখনও পনিরের দেখা মিলবে না, কারণ প্রাণীজ প্রোটিন আছে বলে সেও প্রায় আমিষ গোত্রীয়।
আরও শুনুন:
দুর্গা এল! ‘পথের পাঁচালী’-তে প্রথমে যাকে জায়গা দেননি বিভূতিভূষণ
তা বলে কি আমিষ থাকবে না ভোগের দিনে? কে বলেছে সে কথা! রুই আর ইলিশ মাছের মাথা, দুরকম কুমড়ো দিয়ে তৈরি হত এক চচ্চড়ি যা শুধুমাত্র পুজোর সময় রান্না হত বলে তার নাম হয়েছিল দুর্গাচচ্চড়ি। আর বলি হওয়া কচি ছাগলের মাংস পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া শুধুমাত্র লঙ্কা-আদা-জিরে বাটা দিয়ে রান্না হত, যার পোশাকি নাম ‘নিরামিষ মাংস’। আবার ওপার বাংলার পাবনা, চট্টগ্রামের মতো জায়গার পুজোবাড়িতে দশমীর দিন পান্তাভাতের সঙ্গে থাকত জোড়া ইলিশ এবং সামান্য আখের গুড় আর তেঁতুলের ক্বাথ দিয়ে বানানো পদ্মের নালের টক। খুলনা এবং বিক্রমপুরে যেমন শাপলা ফুলের নালের টক হত, তেমনই বাংলার বর্ধমান বা কৃষ্ণনগরের মতো পুরনো জায়গার পুজোয় মৌরলা মাছের টক খাওয়ার প্রথা আছে।
ভূরিভোজের পরে মধুরেণ সমাপয়েৎ না করলে কি চলে? সেকালে বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে রসবড়া, লবঙ্গলতিকা, নারকোল ও তিলের নাড়ু, মুড়ি ও চিঁড়ের মোয়ার সঙ্গে তৈরি হত পূর্ণচন্দ্রপুলির মতো সাবেক মিষ্টি। দু’টি চন্দ্রপুলিকে ব্যাস বরাবর জুড়ে দিলে যে বৃত্তাকার মিষ্টিটি তৈরি হয়, তাই হল পূর্ণচন্দ্রপুলি। শেষ পাতে থাকত কোনও দিন বোঁদের আবার কখনও রসগোল্লার পায়েস। শোনা যায়, কোনও এক বনেদি বাড়িতে পায়েসের জন্য ছোট ছোট রসগোল্লা আনা হত ল্যান্সডাউন রোডের সাবেক দোকান থেকে। একবার নাকি ভুল করে কে তার বদলে দানাদার এনেছিল। ঘন দুধে তা জ্বাল দেওয়ার পরে অভাবনীয় সাফল্য মেলে। সেই থেকে মাঝেমধ্যে ও বাড়িতে দানাদারের পায়েস ফরমাইশ করতেন কর্তারা।
আসলে ভোজনরসিক বাঙালির পেটপুজো না হলে তার পুজোই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এবার নাহয় সে পুজোতেও খানিক বাঙালিয়ানার পরশই মিশে থাকল, কী বলেন?