এই সেদিনও তাঁকে পাপ্পু বলে ব্যঙ্গ করে উড়িয়ে দিত শাসক শিবির। রাহুল গান্ধী যে দেশ ও দশের জন্য বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবেন না, এই কথাটাই বারবার করে বলা হত। অথচ বর্তমানে সেই রাহুলকেই যেন অনেখানি গুরুত্ব দিচ্ছে শাসক। কোন রসায়নে বদলে গেল রাজনীতির এই পট? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
একসময় তাঁকে ‘পাপ্পু’ বলে স্রেফ উড়িয়ে দিত বিজেপি। কিন্তু এখন তাঁকে নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও। অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবি ভাষণে মোদির বক্তব্যের একটা অংশ জুড়ে রইল রাহুল গান্ধীর কথার পালটা উত্তর। রাজনীতির জগতের ‘কেউ না’ থেকে কীভাবে এতখানি গুরুত্ব বাড়ল রাহুলের? কেনই বা তাঁকে নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী বিজেপি শিবির?
আরও শুনুন: ধর্ষণের ঘটনাতে সায় মহিলাদেরও! অরুন্ধতী বলছেন, আমাদের এখন ‘গভীর অসুখ’
আসলে, ভারতবর্ষে রাজার ছেলের রাজা হওয়াটাই দস্তুর। সেই ট্র্যাডিশন মেনেই ইন্দিরা, রাজীবের পর রাহুলকে দেশের মসনদের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তুলে ধরেছিল কংগ্রেস। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তিনি কতখানি পরিণত, তা বিচারের আগেই তাঁর মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রত্যাশার ভার। আর সেই ফাঁকটাতেই দিনের পর দিন জোরালো আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছে বিজেপি। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকা এই নেতার কণ্ঠরোধ করার জন্য যেনতেন প্রকারেণ তাঁর একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে চেয়েছিল মোদি শিবির। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, নেতাদের বক্তব্যে, মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যেভাবে নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা একাধিক চিন্তাশীল বিদ্বজ্জন সম্পর্কে জনমানসে ঘৃণার চাষ করা হয়েছে, রাহুলের ক্ষেত্রেও করা হয়েছিল তেমনটাই। ক্ষমতাশালী পরিবারের অপদার্থ সন্তান, এই মর্মেই রাহুলের গায়ে ‘পাপ্পু’ তকমা লাগিয়ে দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। যাতে, আমজনতার কাছে পৌঁছনোর আগেই ওই তকমার আড়ালে চাপা পড়ে যায় তাঁর যাবতীয় শাসকবিরোধী সংলাপ। সত্যি বলতে, কেউ কেউ আরও মনে করেন যে, কেবল বিপক্ষের কাছেই নয়, রাহুলের কিছু কিছু হঠকারী ঔদ্ধত্যে, আলটপকা কাজে কথায় দলের ভিতরেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেই পরিস্থিতিতে ওই তকমাটি তাঁর গায়ে আরও বেশি করে চেপে বসছিল, ফলত রাহুলকে নিয়ে বিজেপির মাথা ঘামানোরই প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু, সমস্যা তৈরি করলেন রাহুল নিজেই। অথবা বলা যায়, নিজের সমস্যায় তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন সমাধান। এই মুহূর্তে এ দেশের রাজনীতি থেকে রাহুল গান্ধীর নাম বাদ দিতে পারবেন না কোনও রাজনৈতিক বোদ্ধাই। রাহুল কথা বলছেন জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে। কথা বলছেন বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান হিংসা নিয়ে। বিজেপির ঘৃণা আর বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভালবাসার কথা বলছেন রাহুল। তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রা একদিকে যেমন কংগ্রেসের কর্মীদের চাঙ্গা করে তুলেছে, তেমনই দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে সমস্ত বিরোধী শক্তিকে যাত্রার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলছেন, “ভারত আরএসএসের জায়গির নয়”। এই রাহুল গান্ধী যেন ঠিক সাবেকি কংগ্রেস নেতা নন। গান্ধী পরিবারের আভিজাত্য দিয়েও তাঁকে পুরোপুরি ধরা যায় না। ভারত জোড়ো যাত্রায় তিনি যে তীব্রতায় গৌতম আদানি এবং মুকেশ আম্বানির মত দুই বিরাট কর্পোরেটকে আক্রমণ করেছেন, দেশের কর্পোরেট উত্থানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তা সমীহ জাগানোর মতোই। এই সময়ে দাঁড়িয়ে রাহুল এমন একজন নেতা, যিনি স্পষ্টভাবে বলছেন, ২০২৪ সালের লড়াইটা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং অনেক বেশি করে আদর্শের। আর সেই কারণেই, শুধুমাত্র নির্বাচনী পাটিগণিতে হয়তো এই লড়াইকে দেখছেন না তিনি। তাই ভারত জোড়ো যাত্রা চলাকালীন যেসব রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, রাহুল সেগুলিতে মনোযোগ দেননি। সেই আচরণ কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে গেরুয়া শিবির যে হিন্দুত্ব নামের একনায়কতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ক্রমশ প্রতিস্পর্ধা হয়ে উঠছেন রাহুল গান্ধী।
আরও শুনুন: একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়েই প্রকাশ্যে, রাহুল গান্ধীর নতুন রূপের নেপথ্যেও কি রাজনৈতিক বার্তা?
বস্তুত, ২০১০ সালেও ওড়িশার নিয়মগিরিতে গরিব আদিবাসীদের উৎখাত করে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের কর্পোরেট আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। যা রুখে দিয়েছিলেন সেদিনের যুবক রাহুল। এর আগেও উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের হয়ে কথা বলেছিলেন তিনি, যেমন এখনও কৃষকদের সঙ্গে ট্রাক্টর নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে দেখা গিয়েছে তাঁকে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে গিয়েছেন, হিজাব নিয়ে নিষেধাজ্ঞায় যে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে কথা বলেছেন। গণপিটুনিতে নিহত আখলাক আহমেদের বাড়ি থেকে হাথরাসের ধর্ষিতার বাড়ি, বারবার ছুটে গিয়েছেন রাহুল।
আর সেইখানেই বোধহয় বিজেপির কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছেন রাহুল গান্ধী। সম্প্রতি রাহুলের সাংসদ পদ নাকচ করার জন্য শাসক পক্ষের যে তৎপরতা দেখা গিয়েছে, সেদিকে ইঙ্গিত করেছে খোদ সুপ্রিম কোর্ট। মোদি পদবি মামলায় রাহুলকে কেন সর্বোচ্চ সাজা শোনানো হল, তার যৌক্তিকতা মেলেনি বলেই মত শীর্ষ আদালতের। কিন্তু এই মুহূর্তের রাজনৈতিক মানচিত্রে মোদি সরকার যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে, তা কি এক্ষুনি নড়িয়ে দিতে পারবেন রাজীবতনয়? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, না, তা হয়তো পারবেন না। কিন্তু সংঘ পরিবারের আদর্শের উলটো একটা বয়ান যে তৈরি হচ্ছে রাহুলের হাত ধরেই, সে সত্যকে আর এড়িয়ে যাওয়ার জো নেই। রাহুল গান্ধীর সংসদে প্রত্যাবর্তন কেবলমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত বা দলগত বিষয় হয়ে থাকছে না, তা এক অর্থে হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে একটি জয়ের স্মারক। চব্বিশের নির্বাচন না হোক, আগামী নির্বাচনে বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার সামনে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে এই গণতন্ত্রের বিকল্প স্বর। আর সেই কারণেই, একদা যাঁকে ‘পাপ্পু’ বলেই ব্যঙ্গ করত, আজ তাকে গুরুত্ব না দিয়ে আর বোধহয়য় কোনও উপায় নেই গেরুয়া শিবিরে। দেশের গণতন্ত্রের জন্য তা কতখানি স্বস্তিদায়ক, সে বিচারের ভার বিশেষজ্ঞদের হাতেই থাকল। তবে রাহুলকে যে আর ব্যঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, শাসক শিবিরের নানা পদক্ষেপে সেই সত্যটিই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে সংসদীয় রাজনীতিতে।