আর জি কর কাণ্ডে প্রথম থেকেই অভিযোগ উঠেছে, অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে। অথচ ধর্ষকদের শাস্তি না হলে যে তারা এবং তাদের মতো আরও অনেকেই আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার লাইসেন্স পাবে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! তারপরেও গোটা দেশে ধর্ষণ আর শাস্তির পরিমাণ ব্যস্তানুপাতিকই, বলছে তথ্য।
আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়া তরুণী যেভাবে নিজের কর্মক্ষেত্রে ডিউটির সময়েই ধর্ষণ-খুনের শিকার হলেন, সে ঘটনা সামগ্রিকভাবে মেয়েদের বিপন্নতার প্রশ্নকেই সামনে এনেছে। দাবি উঠছে ন্যায়বিচারের। একই সূত্রে ধর্ষকদের চিহ্নিত করা এবং দ্রুত শাস্তির দাবি উঠছে। আর এই আবহেই বারবার অভিযোগ উঠছে যে, অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সরকার, দুদিকেই অভিযোগের নিশানা। হ্যাঁ, শাস্তি হলেই যে ধর্ষণের প্রবণতায় ইতি টানা যাবে, তেমনটা হয়তো নয়। তা আরও গভীর প্রচেষ্টা দাবি করে। কিন্তু তা বলে অন্যায়ের শাস্তি হবে না, এমনটাও তো কোনও সভ্য সমাজ বলতে পারে না। বিশেষ করে অন্যায় যেখানে এতখানি নৃশংস। ধর্ষকদের শাস্তি না হলে যে তারা এবং তাদের মতো আরও অনেকেই আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার লাইসেন্স পাবে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! অথচ, গোটা দেশের নিরিখেই তথ্য বলছে, ধর্ষণ আর শাস্তির পরিমাণ ব্যস্তানুপাতিকই। ধর্ষণের প্রবণতা যে হারে বাড়ছে, সে হারে আইনি শাস্তির ঘোষণা নেই।
আরও শুনুন:
কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার মুখোমুখি, ভারতীয় আইনে কীভাবে সুরক্ষা পেতে পারেন নারীরা?
আর জি কর কাণ্ড নতুন নয়। নতুন নয় ধর্ষণের ঘটনাও। দেশজুড়ে নিয়মিত ভাবে ধর্ষণের মুখে পড়েন নানা বয়সের, নানা শ্রেণির মেয়েরা- সে কথা সরকার মানুক কিংবা নাই মানুক। ভয়ের কথা এটাই, যে, ছোটখাটো হেনস্তার ঘটনা যেমন আগে প্রকাশ্যে আসত না, তেমনই এখন ধর্ষণের ঘটনাও আমাদের কাছে জলভাত হয়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড নৃশংসতা, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতার ছায়া না থাকলে তা বড় খবর হয় না। ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের ভয়াবহতা গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবিতে মুখর হয়েছিলেন সারা দেশের মেয়েরা। সেই সময়েই, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র তথ্য জানিয়েছিল, এক বছরে দেশে অন্তত ২৫ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।
সে সংখ্যাটা ক্রমশ বেড়েছে বই কমেনি। ২৫ থেকে পৌঁছেছে ৩০ হাজারে। ২০১৬-তে তা দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার। ২০১৮-র হিসেব বলেছে, প্রত্যেক ১৫ মিনিটে দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে ধর্ষিতা হচ্ছেন কোনও না কোনও মহিলা। ২০২০-২১এর কোভিডে কোয়ারেন্টাইন আর লক ডাউন সাময়িকভাবে সে সংখ্যা খানিক কমিয়েছিল, কিন্তু ২০২২-এই ৩১ হাজারের বেশি ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশের কাছে। তথ্য আরও বলছে, প্রতিদিন গড়ে ৯০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সে বছরে। যদিও বেসরকারি হিসেবটা যে আরও কত বেশি, তা কে জানে!
আরও শুনুন:
রাতের পথে কেবল ধর্ষকের অধিকার নাকি! বহু আগেই শুরু ‘টেক ব্যাক দ্য নাইট’ আন্দোলনের
ধর্ষণের হার বাড়ছে। কিন্তু শাস্তি কই? দেখা যায়, প্রায় সব ধর্ষণের পরই ধর্ষিতাকে প্রশ্ন করতে মাঠে নেমে পড়েন দলে দলে লোক। মেয়েটির বয়স কত, কী পোশাক পরে ছিল, ট্যাটু আছে কি না, ধূমপান-মদ্যপান করে কি না, পুরুষ বন্ধু আছে কি না- এমনই নানা প্রশ্নে তার চরিত্র বিচার চলে। চরিত্র যাই হোক, তাও যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকেই ছোঁয়া যায় না, পুরুষ কিংবা নারী কাউকেই না- এই সহজ কথাটা আজও আমরা সহজে বলে উঠতে শিখিনি। তাই মেয়েটি কেন ওখানে গিয়েছিল, কেন ওই সময়ে গিয়েছিল- এমনতর প্রশ্নে দোষারোপ করেই ধর্ষণের দায় এড়ানো যায়। কেবল আমজনতাই তো নয়, এহেন মন্তব্য উড়ে আসে প্রশাসনিক নেতানেত্রী, পুলিশের কাছ থেকেও। কেউ বলেন, এমনটা তো হয়েই থাকে, কেউ বলেন সাজানো ঘটনা, কেউ প্রেমিকের সঙ্গে ঝগড়ার তত্ত্ব খাড়া করেন, কেউ আবার সরাসরি মেয়েটিকে যৌনকর্মী বলতেও দ্বিধা করেন না। যদিও, যৌনকর্মী হলেও যে কাউকে ধর্ষণ করা অন্যায়, সে কথা তো আমরা শিখিনি। আর এই সবকিছু মিলিয়েই ফিকে হয়ে আসে শাস্তির দাবি। নির্ভয়া কাণ্ডের ১০ বছর বাদেও জানা যাচ্ছে, দেশে নারীকেন্দ্রিক অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির হার মাত্র ২৬.৫ শতাংশ। আর ঝুলে থাকা মামলার হার? ৯৫ শতাংশ! অর্থাৎ, যত ধর্ষণ নির্যাতন ঘটে, তার ১০০টির মধ্যে মাত্র ৫টি মামলার নিষ্পত্তি করে রায় ঘোষণা করতে পেরেছে আদালত।
আরও শুনুন:
তথ্য আরও জানায়, এই হিসেবের মধ্যে যে রাজ্যগুলির অবস্থা সবচেয়ে করুণ, পশ্চিমবঙ্গ তাদের অন্যতম। এখানে শাস্তির হার মাত্র আড়াই শতাংশ, আর ঝুলে থাকা মামলার হার ৯৮.১ শতাংশ- জানাচ্ছে ২০২২ সালের তথ্য। দু’বছরে অবস্থা বিপুল বদলে গিয়েছে, এমনটা ভাবার আশা মেলে না। আর জি করের ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তুলল, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্রেফ স্লোগান হয়েই থেকে যাবে না তো! যে মেয়েটি বেঁচে থাকতে সুরক্ষা পাননি, মরে যাওয়ার পর সুবিচারটুকুও কি জুটবে তাঁর ভাগ্যে? সে উত্তর হয়তো সময়ই দিতে পারে।
[ছবি: অঙ্কুর নন্দী]