রাম কী খেতেন, ক্রমে সে কথাই মুখ্য হয়ে গেল দেশের রাজনীতিতে। রামরাজ্যের সুশাসনের প্রসঙ্গ তলিয়ে গেল কোথায়! ভোটের রাজনীতিতে খাবারের স্বাদ নিয়েও কথা হতেই পারত, কিন্তু বিভিন্ন স্বাদকোরককে নষ্ট করে কেবল এক দেশ এক স্বাদের পক্ষে সওয়াল চালালে গোটা রান্নাটাই বিস্বাদ হতে বাধ্য।
মানুষের হৃদয়ে পৌঁছনোর সেরা রাস্তা নাকি তার পাকস্থলীর মধ্যে দিয়ে। যাঁরা ভালো রাঁধেন, তাঁরা এ কথা হামেশাই বলে থাকেন। কিন্তু কথাটা হল, আজকাল রাজনীতিকেরাও তেমনটাই ভাবছেন কি না, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে লোকসভার আগে দেশের রাজনীতিতে খাবারদাবারের যে লাগাতার আনাগোনা ঘটছে, তাতে সে কথা মনে হলেও দোষ দেওয়া চলে না। মাছ, মাটন, পোলাও, সবই যেন এখন রাজনীতির ময়দানে নিত্যনতুন প্রার্থী।
আরও শুনুন:
শ্রাবণ মাসে মাংস খায় না হিন্দুরা! রাহুল-লালুর পুরনো ভিডিও টেনে ‘মুঘল’ তকমা মোদির
মিষ্টিমুখ দিয়েই যদি শুরু করা যায়, দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিতে বর্তমানে তার অভাব হচ্ছে না। সে ভোটের আগে নেতানেত্রীদের মুখের কথা যতই তেতো হোক না কেন! সদ্য রাজনীতিতে আসা রচনা যেমন নির্বাচনী কেন্দ্রে গিয়ে দই খেতেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়লেন, এমনকি তা নিয়ে কার্যত গরুর রচনাও লিখে ফেললেন। এদিকে রাহুল আবার দিনকয়েক আগেই মাইশোর পাক কিনে স্ট্যালিনকে খাওয়াতে ছুটেছেন। যদিও দৌড়ের নেপথ্যে জারি মোদিকে হারানোর তাগিদ। চব্বিশের ভোটে দক্ষিণকে দলে টানতে নাছোড়বান্দা বিজেপি। বারবার সফরে যাচ্ছেন খোদ মোদি। সম্প্রতি এক চ্যানেলে তিনি বলে বসলেন, তাঁর প্রিয় তামিল খাদ্য উপমা, তবে পোঙ্গলও কম যায় না। তারপরেই মাইশোর পাক কিনে স্ট্যালিনের হাতে ‘মিষ্টি জয়’-এর নিশান তুলে দিয়ে এলেন রাহুল। মাইশোরের রাজা কৃষ্ণরাজা ওয়াদেয়ারের পাচকের হাতে যা তৈরি হয়েছিল, সেই মাইশোর পাক তো যে কোনও মিষ্টি নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার বাড়ানোয় ওয়াদেয়ারের অবদানের কথা গোটা দক্ষিণই জানে। সুতরাং মুখে কিছু না বলেও মোদিকে পালটা দিলেন বটে রাহুলরা।
ডেসার্ট ছাড়ুন, মেন কোর্সের পদও কি কম! এমনিতে রাজস্থানের মিছিল থেকে মোদি ঘোষণা করেছেন, তিনি সবে অ্যাপেটাইজার বেড়েছেন মাত্র। মেন কোর্স এখনও বাকি। তা সেই ভূরিভোজ বোধহয় বিশেষ করে বিরোধীদের জন্যই সাজিয়েছেন তিনি। কারণ খাবারের কথা তুলেই বিরোধীদের নিশানা করাটা প্রধানমন্ত্রী একরকম অভ্যাস করে ফেলেছেন। এককালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ সগর্বে বলেছিলেন, যতদিন শিঙাড়ায় আলু থাকবে, ততদিন বিহারেও লালু থাকবে। সম্প্রতি খাবার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর নিশানায় তাঁরই ছেলে, তেজস্বী যাদব। নবরাত্রির সময়ে কেন তিনি মাছ খেয়েছেন, তা নিয়েই তাঁকে বিঁধতে ছাড়ছেন না মোদি। আবার ইন্ডিয়া জোট গড়ার গোড়ার দিকে লালু আর রাহুলকেই একসঙ্গে চম্পারণ মাটন রান্না করতে দেখা গিয়েছিল। ভোটের আগে সেই পুরনো মশলা ছড়িয়েই প্রচারের ঝাঁজ বাড়াচ্ছেন মোদি। শ্রাবণ মাসে মাংস খাওয়াকে মুঘলদের মতো মানসিকতা বলে লালু-রাহুলকে একযোগে তোপ তাঁর। তাতে অবশ্য একসঙ্গে মাঠে নেমে পড়েছেন মমতা-অভিষেক। যে বাঙালি পুজোর ভোগে পর্যন্ত ইলিশ-পাঁঠাকে টেনে আনে, তাদের সামনে মাছ খাওয়া নিয়ে আপত্তি করার জো আছে! ‘বিজেপি হটাও, মাছ ভাত খাও’ নামে একটা গোটা ক্যাম্পেনই হাজির করে ফেলেছে ঘাসফুল শিবির। শুধু তৃণমূল নয়, কদিন আগেই গোমাংস খাওয়া নিয়ে কঙ্গনা রানাউতকে তোপ দেগেছেন কংগ্রেস নেতা বিক্রমাদিত্য সিং। যে বিজেপির গরু নিয়ে বক্তব্যের শেষ নেই, তাদের দলের নেত্রীর গোমাংস খাওয়ার পুরনো কথা বিতর্কে ঘি ঢালবে, এ তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও শুনুন:
আমিষ-নিরামিষে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ! বহু রূপে সম্মুখে ফিরছে জাতের ভাগাভাগিই?
আসলে ভোটের রাজনীতিতে স্বাদের আহ্লাদ নিয়ে কথা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন স্বাদকোরককে নষ্ট করে কেবল এক দেশ এক স্বাদের পক্ষে সওয়াল চালালে গোটা রান্নাটাই বিস্বাদ হতে বাধ্য। মোদিরা যে সুরে মাছ মাংস আমিষ সবকিছুর বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছেন, তা আপাতদৃষ্টিতে খানিক হাস্যকর লাগতে পারে। কিন্তু এর আড়ালে যে সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ফোড়ন আছে, তার ঝাঁজ এড়ানোর উপায় নেই। সেখানে আমিষ খাওয়া মাত্রেই যেন অ-হিন্দু, কিংবা মুসলিম, এবং তার মানেই তা দেশবিরোধী, এমনই এক সমীকরণ টেনে ফেলা হচ্ছে নিমেষে। অথচ আমিষ খাওয়াকে যে ‘মুঘল মানসিকতা’ বলে তোপ দাগা হচ্ছে, ইতিহাস বলে, মুঘলদের মধ্যেও ঔরঙ্গজেবের মতো শাসক ছিলেন, যিনি মদ-মাংস খেতেন না। আবার যে রামচন্দ্রকে যাবতীয় রাজনীতির সামনে বিজেপি ঢাল করে দাঁড় করিয়েছে, সেই রামের শিকার করা কিংবা অযোধ্যায় সুরাপানের উল্লেখ বাল্মীকি রামায়ণেই রয়েছে। অথচ রাম মন্দিরের এলাকায় আমিষ রান্না হবে না, কিংবা মদ বিক্রি হবে না, এমন সরকারি ফতোয়া এসেছে একের পর এক। রাম কী খেতেন, সে কথাই মুখ্য হয়েছে, রামরাজ্যের সুশাসনের প্রসঙ্গ তলিয়ে গিয়েছে কোথায়! যেখানে ২০২১ সালের সমীক্ষা বলছে, এ দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষ আমিষ খাওয়ার পক্ষে, অর্থনীতিও বলছে যে বাজারদর বিচার করে আমিষ খাওয়াই এ দেশের বড় অংশের মানুষের কাছে সুবিধাজনক, সেখানে সব মানুষকে কেবল কতিপয় মানুষের স্বাদের হিসেবে বেঁধে ফেলতেই বা হবে কেন! এ দেশ যে বহুমাত্রিকতার কথা বলে, বহু ধরনের খাদ্যও সেই মিশ্র সংস্কৃতিরই অংশ বইকি! সেই স্বাদের অধিকারটুকু জারি রাখার পক্ষেই সওয়াল করুক রাজনীতি, কেননা স্বাদের ভিন্নতাও আদতে ভিন্নমতেরই অংশ আর ভিন্নতার প্রতি সহিষ্ণুতা বজায় রাখতেই শেখায় এ দেশের সংবিধান। পড়শির ফ্রিজে কী খাবার আছে সেই ব্যক্তিগত পরিসরে উঁকি দেওয়ার বদলে, সেই ব্যক্তিগত পরিসর রক্ষা করাই বরং রাজনীতির অঙ্গীকার হোক।