প্রতিদিন সকাল বেলা বাঁশি বেজে ওঠে। না তমাল-তরুমূল থেকে নয়, বরং বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায় মিউনিসিপ্যালিটি বা কর্পোরেশনের লোক। প্রায় শ্যামের বাঁশির মতোই সেই বাঁশির টানও অমোঘ। একদিন কোনও ভাবে বাঁশি মিস মানেই তো বাড়ির আবর্জনা বাড়িতেই ডাঁই। তবে এই যে রোজ সকাল হলেই বাড়ির আবর্জনা হাতগাড়িতে ফেলে আমরা দায়মুক্ত হই, কখনও ভেবে দেখেছি কি, এত জঞ্জাল কোথায় যায়? গোটা পৃথিবীর এত এত আবর্জনা, জঞ্জালের- ঠাঁই হয় কোথায়? আসুন, সে কথাই আজ শোনাব আপনাদের।
সকাল থেকে রাত, দৈনন্দিন জীবনে ঘুম থেকে ওঠা থেকে স্নান, রান্না, খাওয়া সবের শেষেই আবর্জনার ড্রাম ভরে ওঠে জঞ্জালে। প্রতিদিন সকালে আবর্জনা ফেলার গাড়ি এসে সেসব নিয়ে চলে যায়। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন, এই যে পৃথিবীর এত এত মানুষ এত এত আবর্জনা ফেলছে, সেসব যাচ্ছেটা কোথায়!
পৃথিবীর বর্জ্য ম্যানেজমেন্টের কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। বিশ্বে বসবাসকারী মানুষের মোট সংখ্যাটা হিসাব করলে সেই জঞ্জালের পরিমাণটা কী বিপুল দাঁড়ায়, একবার ভেবে দেখুন তো। তার সবটাই যে রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারের যোগ্য তাও নয়। গবেষণা বলছে, পৃথিবীর মোট জঞ্জালের মাত্র ২০ শতাংশ অংশ রিসাইকেল হয়। আর বাকিটা! কোথায় যায় সেই বিপুল জঞ্জাল!
আরও শুনুন: সমুদ্রের বুক থেকে তুলে আনে প্লাস্টিক! মাত্র আট বছরের কন্যার কীর্তিতে অবাক বিশ্ব
প্রথম বিশ্বের দেশগুলি নাকি তাঁদের দেশের জঞ্জাল পাঠিয়ে দেয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। শ্রীলঙ্কা, ফিলিপ্পিনস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো বহু দেশেই এসে জমে হাজার হাজার টন জঞ্জাল। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় ব্রিটেন থেকে নাকি কয়েকশো কনটেনার জঞ্জাল এসে পৌঁছেছিল শ্রীলঙ্কায়। ব্যবহার করা তোষক, কম্বল, কার্পেটের মতো আরও হাজারটা আবর্জনায় ভর্তি ছিল সেসব কনটেনার। এই ধরনের আবর্জনা আবার রিসাইকেল করাও যায় না। শুধু তাই নয়, জৈব আবর্জনাতেও ভর্তি ছিল সেসব কনটেনার। মেডিক্যাল বর্জ্য, এমনকি পচাগলা মানবশরীরের অংশও ছিল তার মধ্যে। প্রায় ৩ হাজার টন আবর্জনায় পূর্ণ এমন ৪৫টি কনেটেনার ফের ব্রিটেনে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা।
তবে শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, ইদানীং অনেক দেশই নাকি এসব এলিট দেশের আবর্জনা নিতে বেঁকে বসেছে। অন্যান্য দেশ থেকে আসা আবর্জনা তাই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেসব দেশেই। খুব বেশিদিন আগেকার কথা নয়। এই প্রথম বিশ্বের দেশগুলির আবর্জনা পাঠানোর হটস্পট ছিল চিন। সেখানে সেসব রিসাইকেল হত। তবে আগেই বলেছি, সমস্ত আবর্জনাই যে রিসাইকেল করা যায়, তেমনটা কিন্তু নয়। ফলে পুনর্ব্য়বহার হয় না, এমন আবর্জনার কারণে মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছিল চিনে। ২০১৮ সালে তাই বেঁকে বসে বেজিং। তাদের তরফে ঘোষণা করা হয়, দূষণ ছড়ায় এমন আবর্জনা দেশে ঢুকতে দেবে না তারা । যার ফলে বিপাকে পড়ে আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশগুলি। বর্জ্য উৎপাদনের দিক দিয়ে সবচেয়ে উপর দিকে রয়েছে নাকি আমেরিকা। বেশ কিছু বর্জ্য পুড়িয়ে ফেললেও, প্রচুর পরিমাণ আবর্জনা তারা সমুদ্রপথে পাঠায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। মালয়েশিয়া, ফিলিপ্পিনস, থাইল্যান্ড. ভিয়েতনামের মতো দেশগুলিতে এসে ভেড়ে সেই আবর্জনা ভর্তি জাহাজ। শুধু এরাই নয়, আবর্জনা গ্রহণ করা দেশের তালিকায় রয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কার মতো তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশও। আমেরিকার বর্জ্য, প্লাস্টিক প্রভৃতি আমদানিকারক দেশগুলির মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। তবে ২০১৯ সালে আমেরিকার বর্জ্যকে না বলে দিয়েছে নয়াদিল্লিও।
আরও শুনুন: প্লাস্টিকের বিকল্প, কমলালেবুর খোসা দিয়ে গিফট ব়্যাপার বানিয়ে তাক লাগালেন ছাত্রী
তবে তাতে যে পুরোপুরি কাজ হয়েছে তা কিন্তু নয়। অনেক সময়ই অবৈধ ভাবে নামগোত্রহীন বর্জ্য আসে ভারতের উপকূলেও। একটি রিপোর্ট জানিয়েছে, ২৫টি দেশ থেকে অন্তত ১ লক্ষ ২১ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিকজাত বর্জ্য জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতের ঘাড়ে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বেআইনি ভাবে সেসব রফতানি করা হয়েছে এ দেশে। তার একটা বড় অংশ গিয়েছে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লির মতো রাজ্যের ভ্যাটে। দূষণের দিক থেকে শীর্ষে থাকা শহরের তালিকায় নাম থাকার বোধহয় এটাও একটা কারণ। এমনিতেই দিল্লি, উত্তরপ্রদেশের মতো শহরে দূষণ একটা বড় সমস্যা। যার জন্য অনেক দিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করছে বিশেষজ্ঞমহল।
জঞ্জালের পরিমাণ যে দিন দিন বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কীভাবে সেই জঞ্জালকে ধ্বংস করা হবে, দূষণের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানো যাবে, তাই-ই এখন মস্ত চ্যালেঞ্জ। সব দেশই এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। যেমন ধরা যাক ভারতের কথাই। দিন কয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে দেশের সবকটি জঞ্জাল ডাম্পিং স্টেশন বা ভ্যাটকে গ্রিনজোনে রূপান্তরিত করবে ভারত সরকার। তাতে হয়তো খানিকটা সুরাহা হবে। তবে এ ব্যাপারে নাগরিকরা যদি সচেতন না হন, তবে সব দেশের সব চেষ্টাই বৃথা যাবে। তাই পৃথিবীকে জঞ্জালমুক্ত করতে হলে গোড়ার কথা হল মানুষের সচেতনতা ফেরানো। তাহলেই জঞ্জাল নিয়ে দেশগুলির মধ্যে এই ঠেলাঠেলি আর বোধহয় থাকবে না।