এককালে অষ্টমীতে মায়ের ভোগে থাকত আমিষ। তখন আবার ছানা বা ছানার পদ ছিল নিষিদ্ধ । সময়ের পরিবর্তনে মাকে ভোগ নিবেদনেও এসেছে নানা বদল। নানা পদের বাহারে সেজে ওঠে অষ্টমীর ভোগ। সেকাল থেকে একাল- মাকে ভোগ নিবেদনের গল্প শোনালেন সৌরাংশু।
ভোগের গল্প করতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ল লর্ড ক্লাইভ আর মহারাজ নবকৃষ্ণ দেবের কথা। নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের অনুবাদক বা তর্জমাকারীর কাজ স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন। এবং ফলস্বরূপ উভয়ের মধ্যে সখ্য তৈরি হয়েছিল। কথিত আছে ক্লাইভের পরামর্শেই নাকি নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর সূত্রপাত করেন। এবং এটিই একমাত্র সাবেকি পুজো যেখানে গোরাদের প্রবেশানুমতি ছিল। যদিও লর্ড ক্লাইভ বা ওয়ারেন হেস্টিংস দূর থেকেই এই পুজো দেখতে পেতেন। তবু তাঁদের শ্রীচরণকমলরেণু পড়ত।
তা পুজোতে গোরা সাহেবরা উপস্থিত থাকলেও, পুজোর ভোগ রান্নার ক্ষেত্রে কিন্তু বেশ জটিল নিয়মকানুন মানা হত। ভোগ রান্নার রাঁধুনেরা সকলেই ব্রাহ্মণ হতেন এবং তখনকার দিনে মায়ের ভোগে মাছ-মাংস সবই থাকত।
তবে একটা জিনিসের অনুপস্থিতি ছিল। আর সেটি হল ছানার তৈরি মিষ্টি। আসলে ছানা ব্যাপারটা বাঙালিদের মধ্যে ঠিক চল ছিল না। ব্রাহ্মণ পরিবারে তো বটেই অন্যান্য হিন্দু পরিবারেও দুধ কাটিয়ে তার থেকে ছানা তৈরি করাটাকে অশুদ্ধ বলে মানা হত। আর ছানার মিষ্টি তো দূরস্থান।
আরও শুনুন: লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ কি দেবী দুর্গার সন্তান?
ছানার প্রবেশ বাঙালি হেঁশেলে মনে হয় মুসলিম শাসকদের হাত ধরেই ঘটে। ফলত ওই আড়াই’শ বছর আগের পুজোয় ময়দা, চিনি, ঘি ইত্যাদি দিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি হত। মিঠে গজা, কটকটি, পেরাকি (হিন্দিতে যাকে গুজিয়া বলে, ময়দার পিঠের মধ্যে নারকেলকোরা চিনি দিয়ে ভেজে তাকে চিনির রস মাখিয়ে যে মিষ্টিটি উত্তর ভারতে ‘হোলি’র সময় ব্যবহৃতহয়।)। এর সঙ্গে থাকত সাদা মোতিচুরের লাড্ডু এবং মন্ডা।
আগে পুজোর ভোগ হিসেবে খুবই প্রচলিত ছিল অথচ এখন আর নানা কারণে হয় না, এমন কয়েকটি পদের নাম করতে বললে প্রথমেই বলতে হয় সাদা ধবধবে ঘি-ভাতের কথা। সুগন্ধী পুরনো গোবিন্দভোগ চালকে, গরুর দুধের সর-তুলে বানানো ঘিয়ের সঙ্গে সামান্য নেড়েচেড়ে ঘি-ভাত তৈরি করা হত। কোথাও কোথাও তাতে আবার সামান্য তেজপাতা, গোটা গরম মশলা, কিসমিস এবং কাজুবাদাম পড়ত।
আরেকটি পদের নাম বেগুন-বাসন্তী। লম্বা করে কাটা ডাঁটি শুদ্ধু বেগুনি বেগুনের ওপর ঝাল-ঝাল সাদা সরষে এবং মিষ্টি-মিষ্টি নারকোল কোরার পরত মাখানো। সাদাসাদা ময়দার ফুলকো লুচির সঙ্গে এই পদ পরিবেশিত হত।
আরও শুনুন: মৃত্যু হয় হুদুড় দুর্গার, দুর্গাপুজোর সময় আজও শোকপালন করেন ‘মহিষাসুরের বংশধররা’
সাবেককালে তিন ধরনের ডালনা ভোগের জন্য রান্না করা হত। এক হল পেঁপের ডালনা, দুই আলু-কাঁচকলা-পটলের হলুদ ছাড়া সাদা ডালনা আর মহার্ঘ্য ছানার ডালনা। এর মধ্যে প্রথম দু’টির চল প্রায় উঠে গিয়েছে। ছানার ডালনা যদিও সেই আড়াইশ বছরের পুরনো নয়, তবে বছর দেড়শ আগেও এর কদর শুরু হয়ে গেছে।
বাকি অংশ শুনে নিন।