কখনও বিটেক পানিপুরিওয়ালি, তো কখনও এমএ পাশ চায়েওয়ালি। ইদানীং কালে এমন ছকভাঙা পথে হেঁটেই স্বনির্ভরতার নয়া সংজ্ঞা লিখছেন অনেক নারীই। কিন্তু ছকভাঙার পথে সবসময় যে প্রগতি থাকে না, থাকে প্রতিবাদের আখ্যানও, সে কথাই সম্প্রতি বুঝিয়ে দিলেন এই পিএইচডি পকোড়েওয়ালি। শুনে নেওয়া যাক।
চাকরি নয়, স্বনির্ভর ব্যবসার পথেই নারীর যোগদান বাড়ছে দেশের শ্রমশক্তিতে। বারে বারে এমনটাই জানিয়েছে সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলি। দেখা যাচ্ছে, ইদানীং কালের কর্মরতা মহিলাদের মধ্যে একটা বড় অংশই অন্ত্রপ্রনর। অর্থাৎ, কোনও বাঁধাধরা চাকরির বদলে তাঁরা নিজেরাই কোনোভাবে উপার্জন করতে শুরু করেছেন। এমনকি সেখানে কোনও প্রচলিত ছকও তাঁরা মানছেন না। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার পর চাকরি করতে হবে, কিংবা কিছু নির্দিষ্ট কাজেই যোগ দিতে হবে, এমন গণ্ডি ভেঙে দিচ্ছেন তাঁরা। এই পথে হেঁটেই ইদানীং কালে প্রচারের আলোয় এসেছেন বিটেক পানিপুরিওয়ালি, এমবিএ চায়েওয়ালি, এমন অনেকেই। নামেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ বিটেক পাশ করেও নিয়মমাফিক ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি নেননি, কেউ আবার এমবিএ ডিগ্রি নিয়েও অন্যরকম কিছু করতে চেয়েছেন। নিজের ইচ্ছেমতো জীবন বাঁচার এই সিদ্ধান্ত কুড়িয়ে নিয়েছে সমর্থনও। কিন্তু কথা হল, এমন ছকভাঙা কাজ মানেই কি তা সবসময় স্বনির্ভরতার কথা বলে? নারীর প্রগতির কথা বলে? নাকি সেখানেই কখনও কখনও লুকিয়ে থাকে নারীর অপমানের গল্প? সম্প্রতি সে প্রশ্নই উসকে দিলেন পিএইচডি পকোড়েওয়ালি। হ্যাঁ, স্বেচ্ছায় পকোড়া ভাজতে শুরু করেছেন বটে, তবে তাঁর এই সিদ্ধান্তের পিছনে যে একরকম বাধ্যতাই রয়েছে। কেননা এই কাজ করার কোনও পরিকল্পনা আগে ছিল না তাঁর। বরং উচ্চশিক্ষার পর পড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। সেইমতোই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দৌলতরাম কলেজে অধ্যাপনার চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ডঃ ঋতু সিং। কিন্তু যেভাবে এক বছরের মধ্যেই তাঁকে কাজ থেকে হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হয়, তাতে নিজেকে অন্যায় আর বৈষম্যের শিকার বলেই মনে করছেন তিনি। আর সেই কারণেই, প্রতিবাদ জানাতেই এই পথ বেছে নিয়েছেন বছর আঠাশের তরুণী। এই পকোড়ার মধ্যে তাই নারীর স্বনির্ভতার কথা জড়িয়ে নেই, বরং লেগে রয়েছে নারীর প্রতিবাদের আখ্যান।
আরও শুনুন:
অনুপ্রেরণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার বুকে ২৪ ঘণ্টার রেস্তরাঁ চালান মধুপর্ণা
এমনিতেই এ দেশে ‘মেয়েদের কাজ’ বিষয়টি এখনও বেশ জটিল। এ দেশের মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার যতখানি বেড়েছে, কর্মরতা মহিলাদের হার সেই অনুপাতে বাড়েনি। উপরন্তু রয়েছে সামাজিক বৈষম্যের জের। অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত ইন্ডিয়া ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট ২০২২-এ বলা হয়েছিল যে, ভারতে মহিলারা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কাজের অভিজ্ঞতার নিরিখে পুরুষদের সমান হলেও বৈষম্যের শিকার হন। যার নেপথ্যে কখনও থাকে নিয়োগকারীর পক্ষপাত, কখনও সমাজে চলা আসা নারীর প্রতি অবহেলা। জন্মসূত্রে দলিত ঋতু জানিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে জাতিবৈষম্যের শিকার হয়েছেন তিনি। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে অন্য পড়ানোর চাকরি তিনি খুঁজতেই পারতেন, কিন্তু তার বদলে সুবিচার চেয়েছেন এই তরুণী। আর তাই কলেজের সামনেই তিনি পকোড়ার স্টল নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ‘বেরোজগারির পকোড়া খেয়ে যান’ বলেই ডাকছেন সকলকে। তাঁর স্টলের গায়ে লাগানো তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার ছবি। স্টলের মেনুতে যে খাবারগুলি রয়েছে, সেগুলোর নামও অভিনব। জুমলা পকোড়া, স্পেশাল রিক্রুটমেন্ট ড্রাইভ পকোড়া, SC/ST/OBC ব্যাকলগ পকোড়া, ডিসপ্লেসমেন্ট পকোড়া, বেরোজগারি চা- এমন সব নামের মধ্যে দিয়েই কলেজ কর্তৃপক্ষকে তোপ দেগেছেন তিনি। মেনুর নিচেই লেখা, ‘এডুকেট, অর্গানাইজ, অ্যাজিটেট’। অর্থাৎ শিক্ষার উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশিই সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন এই দলিত তরুণী।
আরও শুনুন:
মজুরি কাটার ভয়! ঋতুস্রাব এড়াতে জরায়ুও কেটে বাদ দিয়েছেন মহিলারা
যদিও ইতিমধ্যেই পুলিশ মামলা দায়ের করেছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপরেও নিজের লড়াইটা ছাড়তে নারাজ এই তরুণী। একে দলিত, তায় নারী, দুরকমের প্রান্তিক পরিচয় নিয়েই তিনি লড়ে যেতে চান। আর তাঁর এই অভিনব লড়াইয়ের আরও একটি কথাও মনে করাচ্ছে। যেসব নারী স্বনির্ভরতার নয়া উপায় খুঁজছেন, নিয়োগকারীর তোয়াক্কা না করে নিজের শর্তে জীবনে এগোতে চাইছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানাতেই হয়। কিন্তু মেয়েরা কী কাজ করবেন, কীভাবে কাজ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার যেন তাঁদের থাকে, সেদিকটিতেও নজর রাখা জরুরি। দেশের নারীশক্তি নিয়ে এত এত স্লোগানের আবহে তাই সেই প্রশ্নও জারি থাকুক।