“ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে”- এই ভয় থাকে শাসকের। আর সেখান থেকেই শ্রেণিকক্ষে নিজের রং লাগাতে চায় যে কোনও শাসকই। দেশ যা করছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ ও সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যদি তাকে যেতে না হয়, তবে সে একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। দেশকে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব ভবিষ্যতের নাগরিকের, অর্থাৎ আজকের তরুণ শিক্ষার্থীদের। আর সেখানেই শিক্ষকের ভূমিকাটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে তার শ্রেণিকক্ষেই। বা বলা ভালো, ক্লাসরুমেই সেই ভবিষ্যৎ আকার নিচ্ছে। এ কথা বলেছিল সরকারের কোঠারি কমিশন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সালের কার্যক্রমের ভিত্তিতে এই কমিশন যে রিপোর্ট দেয়, সেখানেই এই কথাটি বলা হয়েছিল। আর এই কথাই ফিরে আসে শিক্ষক দিবসের আবহে, শিক্ষকের বিপুল দায়িত্ব ও গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে।
আসলে শিশু যদি চারাগাছের মতো হয়, তাকে প্রয়োজনীয় সার জল দিয়ে বড় করে তোলাই শিক্ষকের কাজ। গাছের মতোই, প্রতিটি মানুষের গড়ন আলাদা। সেই গড়নকে চিনে নিয়ে তাকে লালনপালন করাই শিক্ষকের কাজ। সেই ভিন্ন ভিন্ন গড়নকে কোনও একটিমাত্র ছাঁচে বেঁধে ফেলা নয়। বস্তুত ক্ষমতার একটি ধরন হল, শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তার নিজের কথা চারিয়ে দেওয়া। তার নিজের সপক্ষে কথা বুনে দিয়ে নিজের সমর্থন বাড়িয়ে নেওয়া। বুঝে ওঠার বয়স হওয়ার আগেই ছোট ছেলেমেয়েদের দিয়ে যদি কোনও একপাক্ষিক মত গিলিয়ে ফেলা যায়, তবে তাদের অন্য কথা ভাবার মতো পরিসরটিই তৈরি হয় না। বিজেপির শাসনামলে শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের অভিযোগ উঠেছে বারবার। তা সে আইআইটির মতো উচ্চমানের প্রযুক্তিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরু ও গোমূত্র নিয়ে গবেষণা বা আলোচনা, ডাক্তারির সিলেবাসে আয়ুর্বেদ-সহ প্রাচীন ভারতীয় বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতির অন্তর্ভুক্তির চেষ্টাই হোক, কিংবা স্কুলশিক্ষায় মোগল ইতিহাস থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ মুছে ফেলাই হোক। ভারতে রাজনীতির বয়ানে ও সমাজমনে যে ধর্মীয় বিদ্বেষ চারিয়ে দেওয়া গিয়েছে এরই মধ্যে, সেই বৃহৎ পরিকল্পনারই অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল স্কুলশিক্ষা- এমনটাই মনে করেন শিক্ষামহলের এক অংশ, মনে করেন আরও অনেকেই। সত্যি বলতে, যে কোনও ক্ষমতার ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা দেখা যেতে পারে। “ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে”- এই ভয় থাকে শাসকের। আর সেখান থেকেই শ্রেণিকক্ষে নিজের রং লাগাতে চায় যে কোনও শাসকই।
আর সেখানেই শিক্ষকের ভূমিকাটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কেন-না এই বেঁধে দেওয়া গতের বাইরে খোলা চোখে দেখাতে পারেন একজন শিক্ষক। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই দেশে সকলের জন্য শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে স্কুলের উপযুক্ত বিকল্প এখনও তৈরি হয়নি। সেখানেই শিক্ষকের তরফে প্রশ্ন তোলার অধিকার জিইয়ে রাখা জরুরি। দেশ যা করছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ ও সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যদি তাকে যেতে না হয়, তবে সে একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। দেশকে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব ভবিষ্যতের নাগরিকের, অর্থাৎ আজকের তরুণ শিক্ষার্থীদের। তাই তাদের ভাবা আর প্রশ্ন করার অভ্যাস না থাকলে সমূহ বিপর্যয়। হীরক রাজার দেশে এই প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছিলেন উদয়ন পণ্ডিত। এ দেশ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও সংকীর্ণ ‘এক’-এর নয়, বহু ও বহুত্বের শিক্ষাই তার মূলে রয়েছে, এ কথা ভুললে চলবে না। আর সে কথা শিক্ষার্থীর তরুণ মনে গেঁথে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষককেই।