তিনি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। আবার, দেশের রাষ্ট্রপতি যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও তিনি অগ্রগণ্য। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর ব্যতিক্রমী ভাবনার। তাঁর কাজেও এরই প্রতিফলন দেখি আমরা। আর তাই, ড. এ পি জে আব্দুল কালাম, এই নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় দেশবাসীর। ব্যক্তিজীবনে কতটা ব্যতিক্রমী ছিলেন তিনি? তাঁর জীবনের নানা ঘটনাতেই আছে সেই প্রমাণ। আমরা শুনব, তেমনই কিছু গল্প।
মন দিয়ে কাজ করছিলেন এক বিজ্ঞানী। তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলেন ড. এ পি জে আব্দুল কালাম। তাঁরই তত্ত্বাবধানে একটি প্রজেক্টে কাজ করছিলেন ওই বিজ্ঞানী। যেদিনকার ঘটনা, সেদিনই একটু আগে ছুটি পাওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সন্তানকে নিয়ে একটি প্রদর্শনীতে যাওয়ার কথা, তাই ছুটির দরবার। ছুটি মঞ্জুরও করেন ড. কালাম। কিন্তু কাজের চাপে মাথা তোলার জো নেই বিজ্ঞানীর, বাড়ি ফিরবেন কী করে! কর্মরত ওই বিজ্ঞানীকে দেখে সেদিনের মতো অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে ড. কালাম। বেশ রাতে যখন বিজ্ঞানী সেদিনকার মতো তাঁর কাজ শেষ করে উঠলেন, তখন আর প্রদর্শনীতে যাওয়া সম্ভব নয়। ড. কালামের চেম্বারে গিয়ে দেখলেন, তিনিও বেরিয়ে গিয়েছেন। ক্ষুণ্ণ মনে বাড়ির পথ ধরলেন তিনি। আর তারপরেই চমক। বাড়ি ফিরে দেখলেন, তাঁর সন্তান বেশ খুশি। অথচ এর ঠিক উলটোটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ব্যাপারটা কী? তখন তাঁর স্ত্রী খোলসা করে জানালেন ব্যাপারটা। জানালেন, তাঁদের বাড়ি এসেছিলেন স্বয়ং ড. কালাম। তিনিই বাচ্চাটিকে প্রদর্শনী থেকে ঘুরিয়ে এনেছেন। সব বৃত্তান্ত শোনার পর তাজ্জব হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী কিনা তাঁর সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন! হ্যাঁ, এমন মানুষই ছিলেন ড. এ পি জে আব্দুল কালাম। তাঁরই তত্ত্বাবধানে যিনি কাজ করছেন, তিনি ফুরসৎ পাচ্ছেন না দেখে, নিজেই তাঁর হয়ে বাচ্চাকে খুশি করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
আরও শুনুন: দ্রৌপদী নাম হয়েছিল স্কুলে, নিজের ‘আসল’ নাম জানালেন দেশের নয়া রাষ্ট্রপতি
এই সাধারণ একটি গল্পের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে মানুষটির অসাধারণত্ব। ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে জন্ম হয় এ পি জে আব্দুল কালামের। পদার্থবিদ্যা ও এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে করেছেন পড়াশোনা। দীর্ঘ চারদশক ধরে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত ছিলেন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সঙ্গেও। তাঁর মনোগ্রাহী বক্তৃতায় মুগ্ধ ছিল জনসমাজ। আর মানুষ হিসাবেও যে তিনি অনন্য, তাঁর জীবনের এই ছোট ছোট গল্পগুলিই যেন আমাদের সে-কথা বলে দেয়।
আরও শুনুন: অটোগ্রাফই জীবনবিমা! চাঁদে যাওয়ার আগে কী পরিকল্পনা করেছিলেন মহাকাশচারীরা?
আর একটি ঘটনার কথা শোনা যাক। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোয় আন্তর্জাতিক একটি কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন ড. কালাম। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রও। ড. কালাম তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। কথা বলতে বলতেই, এক পড়ুয়াকে তিনি বলেন, তাঁর প্লেট থেকে খাবার খেতে। ভীষণ অবাক হয়ে যান সেই পড়ুয়া। স্যালাড থেকে এক টুকরো তুলে নিয়ে তিনি মুখে পোরেন। এই ঘটনা যে জীবনের সিন্দুকে আজীবন তিনি তুলে রেখেছেন, তা বলাই বাহুল্য। ড. কালাম তাঁর ব্যবহারেই সেদিন সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের মনে কোনও রকম ভেদাভদেরই যেন ঠাঁই না হয়। আরও একটি ঘটনায় এর প্রমাণ মেলে। ড. কালাম যখন রাষ্ট্রপতি, তখন তাঁর অতিথি হিসাবে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এক জুতো সারাইওলা অর্থাৎ মুচিকে। কেরল রাজ ভবনে সেবার তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার দরুন, দুজনকে তিনি নিমন্ত্রণ করতে পারবেন – এই ছিল প্রথা। তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, এক মুচি আর ছোট হোটেলের এক মালিককে। এই অতিথি-তালিকা আমাদের বুঝিয়ে দেয়, রাষ্ট্রপতি হিসাবে ড. কালাম দেশের সকল শ্রেণির মানুষকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দিতেন। বলা যায়, তাঁর এই ব্যবহারই ছিল তাঁর বার্তা।
ড. কালামের সৌজন্যের আর এক ঘটনাও আমাদের অবাক করে। ক্লাস সিক্সের এক পড়ুয়া তাঁর ছবি এঁকেছিল। দেখিয়েছিল বাড়ির সকলকে। সেই ছবি যখন পাঠানো হল ড. কালামের কাছে, তিন তার জবাব দিয়েছিলেন। দেশের রাষ্ট্রপতি, অন্যতম ব্যস্ত বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও এই প্রাপ্তিস্বীকারের সৌজন্যবোধ থেকে তিনি দূরে সরে যাননি। এটিই আমাদের শিক্ষণীয়। ড. কালামের জীবনের এমন অনেক ঘটনাই আমাদের কাছে আসে তাঁর ‘মেসেজ’ হয়ে। মাঝে মাঝেই তিনি চলে যেতেন গ্রামের স্কুলগুলিতে। সেখানকার পড়ুয়াদের শেখাতেন জীবনের পাঠ। তেমনই একবার এক স্কুলে গিয়েছিলেন বক্তৃতা দিতে। ঘটনাচক্রে তাঁর ব্যক্তব্যের মাঝেই বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে ওই এলাকা। কিন্তু তা নিয়ে একটুও অভিযোগ না করে, ড কালাম মঞ্চ থেকে নেমে মিশে যান পড়ুয়াদের মধ্যে। মাইক্রোফোন ছাড়াই উদাত্ত কন্ঠে তাঁর বক্তব্য শোনাতে থাকেন সকলকে। তাঁর মহানুভবতার এমন আরও অনেক গল্পই রয়েছে। কখনও নিজের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা পছন্দ করতেন না। অতিথি হিসেবে কোথাও গেলে বড় চেয়ারে বসতেও চাইতেন না। একেবারে মাটির মানুষদের কাছাকাছি থাকতেই পছন্দ করতেন। আর একটি ছোট্ট তবে বিশেষ ঘটনা দিয়ে শেষ করি। DRDO প্রজেক্টের জন্য একটি বিশেষ ভবনের নিরাপত্তা জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন ড. কালাম। ঠিক করা হয়, সেই ভবনের প্রাচীরের উপর কাচের টুকরো গেঁথে দেওয়া হবে। যা শুনে তখুনি সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, এতে পাখিরা আহত হবে। নিরাপত্তার জন্য যেন অন্য কোনও ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়।
এমনই মানুষ ছিলেন ড. এ পি জে আব্দুল কালাম। জাগতিক নিয়মেই তিনি সশরীরে এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। তবু থেকে গিয়েছেন তাঁর কাজে। এখনও তাই আমরা তাঁকে স্পর্শ করতে পারি তাঁর জীবনের ভিতরকার নিহিত শিক্ষায়।