“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা”… ভাইফোঁটা বলতেই মনে পড়ে এই চিরচেনা উচ্চারণ। কিন্তু কোনও এক যমুনা যমকে ফোঁটা দেন কেন, সেই যম আদতে তাঁর ভাই কি না, এমন কোনও কথা সেখানে নেই। আসলে কোন গল্প লুকিয়ে আছে এর নেপথ্যে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
দুয়ারে কাঁটা পড়া মানে সে পথে যাওয়ার উপায় নেই। ভাইকে ফোঁটা দিয়ে তার যমের দুয়ারে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া হল, এমনই এক আশ্বাস দেয় ভাইফোঁটার চিরচেনা লৌকিক উচ্চারণ। কিন্তু সেই উচ্চারণে কি কেবল ভাইদেরই যমের দুয়ারে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়, নাকি আরও কারও পথ বন্ধ হওয়ার ইঙ্গিত তার আড়ালে রয়ে গিয়েছে? মন্ত্রে যে যম আর যমুনার কথা বলা হয়েছে, তাদের কাহিনি শুনলে যেন তেমনই এক আভাস মেলে।
আরও শুনুন: ঠাকুরবাড়িতে সবার ছোট, কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাইফোঁটা?
ভাইফোঁটার মন্ত্রেই আছে, “যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/ আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা”। এই যমুনার সঙ্গে যমের কী সম্পর্ক, তার কোনও স্পষ্ট উল্লেখ কিন্তু এখানে নেই। আন্দাজ করে নেওয়া যায়, তাঁরা একে অপরের ভাইবোন। সেই অনুমানকেই নিশ্চিত করে ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম সূক্তের শ্লোক বলছে, এক নির্জন দ্বীপে এসে ভাই যমের কাছে মৈথুন প্রার্থনা করে বসেন বোন যমী বা যমুনা। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই যমকে কামনা করে আসছেন তিনি। এখন, এই যৌবনে তিনি যমের ঔরসে একটি সন্তান প্রার্থনা করেন। যদিও যম বোনের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তাঁর মতে, এ বিশুদ্ধ অজাচার। যমী কিন্তু নিরস্ত হলেন না। তাঁর প্রতিযুক্তি ছিল, তাঁরা যমজ সন্তান, গর্ভজলে তাঁরা একই সঙ্গে অবস্থান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, যেহেতু তাঁরা মাতৃগর্ভেই সহবাস করেছেন, তাই বিধাতার অভিপ্রায় বোধহয় এটাই যে, যমের ঔরসে যমীর গর্ভে তাঁদের পিতার এক নাতি জন্ম নিক। তার উত্তরে যমের যুক্তি যেন খানিক দুর্বলই শোনায়। যমের বক্তব্য ছিল, এ স্থান তো নির্জন নয়। দেবতারা সব দিক থেকে দেখছেন। এতে যমী যেন পালটা একটা জোরদার যুক্তি পেয়ে গেলেন। তিনি সাফ বললেন, দেবতারা তো নিজেদের ইচ্ছেমতো মৈথুনে রত হন। যত নিয়ম কেবল মানুষের জন্য রচিত। বরং দেবতাদের অনুকরণ করলেই মানতে হয় যে, মৈথুন তো নিজের ইচ্ছেমতোই হওয়া উচিত। কিন্তু শেষমেশ যমের জেদই বজায় থাকল। যখন সূর্যের ইচ্ছায় পৃথিবী এবং অন্তরীক্ষ একত্র হবে, তখন তাঁরাও দিন ও রাতের মতো একত্র হতে পারবেন, এমন এক আশ্বাস তিনি দিয়েছিলেন বটে। তবে সেই মুহূর্তের জন্য যমীর কামনাকে তিনি স্বীকৃতি দেননি।
আরও শুনুন: মহাবীরের মৃত্যুশোকেই ভাইফোঁটার সূত্রপাত, জানেন এই কাহিনি?
যদিও এই বক্তব্যেও নিরস্ত হননি যমী। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি চলে যান নির্জন দ্বীপের অপর প্রান্তে। সেখান থেকে তিনি যখন ফিরে আসেন, দেখেন, যমের দেহে প্রাণ নেই আর। এরপরই গল্পে আসে নতুন বাঁক। পুরাণকাহিনি বলে, সবার অভিশাপে যমের আয়ু নাকি শূন্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু ধর্ম না থাকলে সমাজ চলবে কী করে? তাই সকলের অনুরোধে ভাইকে বাঁচাতে কঠোর তপস্যায় বসলেন যমী। সেই সাধনার ফলেই যম পেলেন অমরত্ব, আর দেবীর পদে উন্নীত হলেন যমী।
তাহলে সেদিন কি যমের দুয়ারে যাওয়ার পথে কাঁটা পড়েছিল যমীরই? সেই মেয়েটি তো দেবী হতে চাননি। এক মানবীর মতোই তিনি ভালোবেসেছিলেন, ভালোবাসার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন, যা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। যমীর যাবতীয় কামনা আর আবেগকে এককথায় নস্যাৎ করেছিলেন যম। কথা হচ্ছে, এই গল্পে যমী সম্ভোগ ইচ্ছা প্রকাশের পাশাপাশি তার সপক্ষে যে যুক্তি দেন, তা কি আদৌ সম্ভব হত, যদি এহেন সম্ভোগ প্রচলিতই না থাকত? মনে রাখা ভালো, এ কাহিনির যা সময়কাল, সেই সময় বিশ্বে আরও কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতা রয়েছে। তার মধ্যে মিশরীয় সভ্যতা রক্তের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য ভাইবোনের বিবাহে আস্থা রাখত। একই বিশ্বাস প্রচলিত পার্সিদের মধ্যেও, অর্থাৎ পারস্য বা ইরানের প্রাচীন সভ্যতায়। কিন্তু সেই সময়েই যম আর যমীর গল্পে সেই প্রথাকে দেখা হচ্ছে ঘৃণার চোখেই। অর্থাৎ, সেই সাড়ে তিন হাজার বছরেরও আগের সমাজে মৈথুনের ক্ষেত্রে সঙ্গী নির্বাচনে যে স্বাধীনতা ছিল, কালক্রমে তা খণ্ডিত হচ্ছে। আর বাতিল হবে বলেই তা নিন্দিত হচ্ছে। যমের এই তীব্র প্রত্যাখ্যান জানিয়ে দেয়, সামাজিক কাঠামোয় পরিবারের অন্যতর ধারণা তখন দৃঢ় হয়ে আসছে। বৈদিক সভ্যতা যে বিধিবিধানে সমাজকে বাঁধতে চাইছিল, সেখানে যে এমন কোনও প্রবণতার ঠাঁই নেই, এ কাহিনিতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে কথাই। তাও আবার যম তথা খোদ ধর্মরাজের মুখ দিয়েই। আর যে বোন একদিন ভাইকে দেহমিলনের জন্য কামনা করেছিলেন, ভাইফোঁটার মন্ত্রে জুড়ে গেলেন তাঁরাই। এই ফোঁটার মাধ্যমে যে যমের কাছে যাওয়ার পথে কাঁটা পড়ল যমীর, সে ইঙ্গিতই যেন লুকিয়ে রইল কোথাও।