যম-যমুনা বা শ্রীকৃষ্ণ-সুভদ্রা না, চতুর্দশ শতাব্দীর একটি তালপাতার পুথি বলছে, ভাইফোটার সঙ্গে রাজা নন্দীবর্ধন ও তাঁর বোন অনসূয়া জড়িত। এমনকী এই কাহিনিতে বিশেষ ভাবে রয়েছেন মহাবীর। কী সেই কাহিনি?
ভাইফোঁটা সংক্রান্ত দুটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত। একটি কাহিনী তো সব বাঙালির জানা। সেই কাহিনি বলে, যমের মঙ্গল কামনায় ফোঁটা দিয়েছিল বোন যমুনা। সেই থেকেই শুরু ভাইফোঁটার। অন্যটি শ্রীকৃষ্ণ ও সুভদ্রার গল্প। নরকাসুরকে বধ করার পর বোন সুভদ্রার কাছে গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। সেই সময় সুভদ্রা শ্রীকৃষ্ণকে ফুল-মিষ্টি দিয়ে বরণ করেছিল। আরতিও করেছিল। কপালে পরিয়ে দিয়েছিল টিকা। অনেকেরই ধারনা এই মিথই রয়েছে ভাইফোঁটার নেপথ্যে। যদিও আরেকটি স্বল্প পরিচিত কাহিনিও রয়েছে। সেই কাহিনিই ভাইফোঁটার শিকড়, দাবি করেন জৈন ধর্মাবলম্বীদের।
চতুর্দশ শতাব্দীতে সর্বানন্দসুরী নামে এক আচার্য পণ্ডিত ছিলেন। যাঁর একটি তালপাতার পুথি পরে আবিষ্কৃত হয়। পুথির নাম ছিল ‘দীপোৎসবকল্প’। এই গ্রন্থ অনুযায়ী, জৈন ধর্মের অন্যতম তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমানের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর অন্যতম অনুগত সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন মানসিক ও শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়েন। বন্ধ করে দেন খাওয়াদাওয়া। ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে শুরু করেন তিনি। এইরকম অবস্থায় তাঁর বোন অনসূয়া নন্দীবর্ধনকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। দিনটি ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। কাহিনি অনুযায়ী, রাজা নন্দীবর্ধনের কপালে রাজতিলক পরিয়ে দেন বোন অনসূয়া। ভাইকে জোর করে কিছুটা খাবারও খাইয়ে দেন তিনি।
আরও শুনুন: দিওয়ালি সারা ভারতের আলোর উৎসব, কোথায় কেন পালিত হয় জানেন?
এইসঙ্গে আপন ভ্রাতাকে রাজধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেন অনসূয়া। বলেন, “প্রজারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই অনশন তোমাকে মানায় না। হে ভ্রাতা, হে রাজন, রাজতিলক এঁকে দিলাম তোমার কপালে। এবার ক্ষুধা নিরসনের জন্য খাদ্য গ্রহণ করো। সর্ববিধ মঙ্গলের জন্য জেগে ওঠো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি।” অনুসূয়া আরও বলেন, “প্রতি বছর এইদিনে তোমাকে রাজতিলক পরিয়ে অভিষিক্ত করা হবে, এই রইল আমার ব্রত।”
বোনের মুখে এই কথা শুনে রাজা নন্দীবর্ধন তীব্র শোক থেকে ফেরেন। ফের জীবনসত্যে উদ্ভাসিত হন তিনি। অনশন ভেঙে বোনের দেওয়া খাদ্য গ্রহণ করেন। ‘দীপোৎসবকল্প’-এ বর্ণিত এই ইতিহাসকে অনুসরণ করলে ‘ভাইফোঁটা’ উৎসবের শুরুটা আন্দাজ করা যায়। মহাবীরের মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে। সেই হিসেবে এই উৎসবের বয়স মাত্র আড়াই হাজার বছর।
আরও শুনুন: ভারতে নাম দীপাবলি, আলোর এই উৎসব পৃথিবীর অন্য জায়গায় কী নামে পালিত হয়?
এই কাহিনির সত্যতা থাকুক আর না থাকুক। আসল কথা ভাইফোটা সারা ভারতের উৎসব। তাই কোথাও তা ’ভাইটিকা’, কোথাও ‘ভাইদুজ’, কোথাও আবার ‘ভাই বিছিয়া’। কয়েক হাজার বছর ধরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে উদ্যাপিত হয়ে আসছে সম্প্রীতির এই উৎসব। যা সম্পর্কের বন্ধনকে মজবুত করে।