জঙ্গলে নেকড়ে-মায়ের স্নেহে বড় হওয়া একরত্তি বালক শেষপর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারেনি মানুষের জঙ্গলে। মানুষের আদবকায়দা আয়ত্ত করার চেষ্টা করলেও বেশিদিন বাঁচেনি সে। শহুরে জলহাওয়াতে শরীরে দানা বেধেছিল যক্ষ্মার জীবাণু। তা-ই কেড়েছিল প্রাণ। ১৮৭২ সালের সেই নেকড়ে-বালক ওরফে দিনা শনিচরই ছিল মোগলির প্রেরণা। রুডওয়ার্ড কিপলিংয়ের সেই ‘জঙ্গল বুক’-এর নেশায় আজও কাবু আট থেকে আশি। কেমন ছিল বাস্তবের মোগলির জীবন। কেমন ছিল তাঁর লড়াই। আজ শুনে নিন তাঁরই গল্প।
বাঘিরার স্নেহ, বালুর বন্ধুত্ব আর ‘দ্য লোন উলফ’ আকেলা-র শিক্ষায়, জঙ্গলের মতো করেই বেড়ে উঠেছিল সে। নেকড়ে-মা রকষা তাঁর বাকি সন্তানদের মতো করেই আদর-যত্নে বড় করে তুলেছিল মানবশিশু মোগলিকে। শিখিয়ে দিয়েছিল জঙ্গলের নিয়মকানুন। অরণ্যের ছন্দে বড় হওয়া মোগলিই একদিন দুষ্টু শের খানের হাত থেকে মুক্ত করেছিল গোটা জঙ্গলকে। রুডওয়ার্ড কিপলিংয়ের এই গল্প যুগ যুগ ধরে আনন্দ দিয়ে এসেছে আপামর বিশ্ববাসীকে। ছোটপর্দা থেকে বড়পর্দা, শিশু থেকে বুড়ো মজেছে ‘জাঙ্গল বুক’-এ।
কিন্তু বাস্তবের মোগলির জীবনটা বোধহয় এতটাও সহজ ছিল না। অথচ একদিন রুডওয়ার্ডকে প্রেরণা যুগিয়েছিল সেই সত্যি ঘটনাই। তাঁর আধারেই চরিত্র হয়ে উঠেছিল মোগলিরা। তাঁর হাত ধরে এসেছিল বাঘিরা, আকেলা, কিংবা বালুরা। তবে বাস্তবের গল্পে ভিলেন শের খান নয়, অন্য কেউ!
আরও শুনুন: বয়স ১০০ ছুঁই ছুঁই, পেশা জুতো সারাই, নেশা কাউন্সেলিং… এই বৃদ্ধকে দেখে বিস্মিত দেশবাসী
সেটা ১৮৭২ সালের ঘটনা। তখন ভারত শাসন করছে ব্রিটিশরা। উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের কাছে একটি জঙ্গলে শিকার করতে ঢোকে স্থানীয় কয়েক জন শিকারি। চিতাবাঘ, নেকড়ে, শজারু, হায়না, বনবিড়াল, শিয়াল, নীলগাইয়ের মতো অনেক পশুই মিলত সেই জঙ্গলে। তির-ধনুক, গাদা বন্দুক নিয়ে ক্রমশ গভীর জঙ্গলে ঢুকতে থাকে শিকারিদের দলটি। একটি টিলার উপর গুহা দেখে থমকে দাঁড়ায় তাঁরা। অভিজ্ঞরা বলেছিল নেকড়ের গুহা হতে পারে সেটি। শিকারের আশায় চকচক করে উঠেছিল তাঁদের চোখ-মুখ। অল্প কাছে যেতেই চোখে পড়ে গুহার সামনে শুয়ে রয়েছে একটি প্রাণী। বন্দুকের সীমা থেকে দূরে থাকায় সতর্ক ভাবে আরও একটু এগোতে চাইছিল শিকারিদের দল। আর তাদের উপস্থিতি টের পেয়েই বিদ্যুৎবেগে সেই প্রাণীটি গুহার ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল।
শিকারিরা হাল ছাড়েনি। ঘিরে ফেলেছিল গুহাটিকে। শুকনো ঘাস গুহার মুখে জ্বালাতেই ধোয়ায় নাজেহাল হয়ে ভয়ে, গুহার বাইরে বেড়িয়ে আসে নেকড়ে ও বেশ কয়েকটা শাবক। মা-নেকড়েকে মারার জন্য বন্দুক তাক করতেই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান শিকারিরা। অবিকল নেকড়ের মতোই গর্জন করতে করতে গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আসছে একটি মানবশিশু। বয়স পাঁচ কি ছয়! সম্পূর্ন উলঙ্গ সে।
শেষপর্যন্ত নেকড়ে-মাকে হত্যা করে কোনও ক্রমে ধরে-বেঁধে মানুষের সমাজে ফিরিয়ে আনা হয় শিশুটিকে। কীভাবে নেকড়েদের মধ্যে বেঁচে রইল শিশুটি, তার কোনও উত্তর খুঁজে পাননি শিকারিরা।
আরও শুনুন: বরফের চাদরের ১০০০ ফুট নিচে বসতি ৬ কোটি মাছের… হদিশ পেয়ে তাজ্জব বিজ্ঞানীরা
আগ্রার সিকান্দ্রার একটি অনাথ আশ্রমে নিয়ে আসা হয় ছেলেটিকে। তার নাম রাখেন দিনা শনিচর। ঊর্দুতে শনিচর শব্দের অর্থ শনিবার। সম্ভবত কোনও এক শনিবারে ওই অনাথ আশ্রমে নিয়ে আসা হয়েছিল বালকটিকে। সেসময় বারের নাম ধরে নাম রাখার চল ছিল বেশ। এই ছেলেটির ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটে।
কিন্তু সভ্য মানবজীবনে কিছুতেই অভ্যস্ত হতে পারছিল না দিনা। তাঁর আচার-আচরণ, হাঁটা-চলা সবেতেই ছিল নেকড়েদের সঙ্গে প্রভূত মিল। এমনকি মাঝেমধ্যেই তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসত রক্তজল করা নেকড়ের ডাক। দু-পায়ে হাঁটতে শেখেনি সে। আশ্রমের ঘরে বাঘের মতোই চার পায়ে পায়চারি করত সে সারা রাত। দিনে পড়ে পড়ে ঘুমাত। জামা কাপড় পরিয়ে দিলে দাঁত নখ দিয়ে ছিঁড়েকেটে একশা করে দিত। সভ্য মানুষের খাবারদাবার মুখে রুচত না তাঁর। কাঁচা মাংস পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার উপরে।
আশ্রমের অন্যরা রীতিমতো ভয় পেত এই বালকটিকে। ততদিনে এই নেকড়ে-বালকের কথা রটে গিয়েছে সর্বত্র। তাকে দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসত লোকজন। আসতেন সাহেব-মেমরাও। সেই সুবাদে বিপুল অর্থও জমা পড়ছিল আশ্রমের তহবিলে। এ ভাবেই দিন কাটছিল।
বাকি অংশ শুনে নিন।